শিরোনাম
৩ কোটির ক্যাশ চেক দিয়ে ডিসির পদায়নের বিষয়টি ভিত্তিহীন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সাম‌নে ৩৫ প্রত্যাশীদের অবস্থান, টিয়ারশেল নিক্ষেপ উন্নয়নের অংশীদার হলেও ১৫ বছরে শ্রমিকরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাননি— দেবপ্রিয় ৩ বছরে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করা প্রায় ১৯ লাখ শিক্ষার্থীর অধিকাংশই বেকার দুই সচিব ও ৬ অতিরিক্ত সচিবকে ওএসডি ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশির পাসপোর্ট ফেরত দিলো ভারত সচিবালয়ে হট্টগোল,শাস্তি পাচ্ছেন ১৭ উপসচিব সাভারে শ্রমিকদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ একজনের মৃত্যু বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা নিয়ে অবস্থান জানাল ভারত ‘পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনী সরকারকে সহযোগিতা করছে’

চীন, নেপাল ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ৯৯ দেখা হয়েছে

প্রফেসর আন্দ্রেয়া ফ্রানসিওনি:- দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতায় এ অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যেকার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। এরমধ্যে চীন, নেপাল এবং ভারতের মিথস্ক্রিয়ার কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়। এই দেশগুলোর মধ্যে থাকা ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কটি বেশ জটিল। ঐতিহাসিক বন্ধন, ভৌগোলিক বাস্তবতা এবং সমসাময়িক কৌশলগত স্বার্থ এই সম্পর্ককে আজকের এই রূপ দিয়েছে। চীন ও নেপাল যত কাছাকাছি আসছে, এই অংশীদারিত্ব ভারতের জন্য তত বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও প্রভাব তৈরি করছে। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে ভারত।

বর্তমানে এই সম্পর্কের গতিশীলতা বোঝার জন্য চীন ও নেপালের মধ্যেকার সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দিয়ে শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও নেপালের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই দুই দেশ বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সিল্ক রোডের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ধারণা প্রবাহিত হয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে নেপাল তার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি ধরে রেখেছে। এই ভারসাম্য বজায় রাখা এখন নেপালের বৈদেশিক নীতির একটি ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে।

সব মিলিয়ে হিমালয় অঞ্চলে তার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগাচ্ছে নেপাল। নেপাল ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক রূপ ধারণ করতে শুরু করে, বিশেষ করে ১৯৪৯ সালে বর্তমানের গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর।

চীন-নেপাল সম্পর্কের এই বিবর্তনের কয়েকটি পর্যায় ছিল। এই সম্পর্ক ছিল ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের। প্রাথমিকভাবে এই সম্পর্কের কেন্দ্রে ছিল সীমান্ত নিরাপত্তা এবং তিব্বতি উদ্বাস্তু সংকট। নেপাল ‘এক চীন’ নীতি গ্রহণ করেছে, যার অধিনে তাইওয়ান ও তিব্বতকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে দেশটি। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামরিক সহযোগিতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সম্পর্কের এই রূপান্তরকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। নেপাল ২০১৭ সালে বিআরআই-তে যোগ দেয়। এরমধ্য দিয়ে চীন-নেপাল সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা হয়। এটিকে নেপালের বৈদেশিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনা ও ভারতের উপর থেকে তার অর্থনৈতিক নির্ভরতা হ্রাসের পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হয়।

নেপালে চীনের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বিগত বছরগুলোতে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। নেপালে চীনা বিনিয়োগ অবকাঠামো, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ এবং পর্যটন সহ অনেক খাতে বিস্তৃত। পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কাঠমান্ডু রিং রোড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট এবং অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নেপালের উন্নয়নে চীনের ভূমিকার কথা তুলে ধরে। এই বিনিয়োগগুলি নিছক অর্থনৈতিক নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে এবং এ অঞ্চলে ভারতের ঐতিহ্যগত আধিপত্য মোকাবেলায় চীনের কৌশলগত নকশার অংশ। তবে নেপালের জন্য চীনের এই বিনিয়োগ তার অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি সুযোগ। যদিও এই এই বিনিয়োগগুলি নেপালের জন্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। এরমধ্যে আছে ঋণের বোঝা ও বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্পগুলির পরিবেশগত প্রভাব।

নেপালের প্রতি চীনের আগ্রহ শুধু অর্থনৈতিক নয়, গভীরভাবে কৌশলগতও। ভৌগোলিকভাবে নেপাল ভারতের সঙ্গে চীনের একটি বাফার হিসেবে কাজ করে। হিমালয় পর্বতমালা প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করলেও নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পৃক্ততা দেশটির দক্ষিণ সীমান্তকে আরও সুরক্ষিত করে। নেপাল যাতে তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ঘাঁটি হিসাবে কাজ না করে তা নিশ্চিত করতে চায় চীন, এতে করে দেশটির সীমান্ত অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

চীন ও নেপালের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব ভারতের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, চীন ভারতকে ঘিরে ফেলছে এমন একটি কৌশলগত উদ্বেগ রয়েছে। চীন ভারতের আশেপাশের দেশগুলিতে তার উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিটিকে প্রায়শই ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’ বলা হয়, যেখানে চীন তার কৌশলগত সম্পদ ও জোট ব্যবহার করে ভারতকে ঘিরে ধরছে বলে মনে করা হয়। ভারত ঐতিহ্যগতভাবে নেপালকে তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে দেখে আসছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত ও নেপালের মধ্যে থাকা উন্মুক্ত সীমান্ত দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ককে সহজতর করে। মানুষ ও পণ্যের অবাধ চলাচল রয়েছে তাদের মধ্যে।

এমন অবস্থায় চীন ও নেপালের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক ভারতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয়। অস্ত্র বিক্রি, যৌথ সামরিক মহড়া এবং সামরিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ সহ নেপালের জন্য চীনের ব্যাপক সামরিক সহায়তা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালে চীনের সামরিক উপস্থিতি বা প্রভাবের বাস্তবতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নয়াদিল্লিকে শঙ্কিত করে তুলেছে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে হিমালয় অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বের কারণে। ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ শুধুমাত্র প্রচলিত সামরিক হুমকির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নেপালের সঙ্গে তার উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে যেমন মানুষ ও পণ্যের সহজ চলাচলের সুবিধা পাওয়া যায়, তেমনি অবৈধ পাচার, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ এবং অনুপ্রবেশের মতো চ্যালেঞ্জেরও মোকাবিলা করতে হয়। ভারত আশঙ্কা করছে, নেপালের ওপর চীনের প্রভাব এই সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
চীন ও নেপালের মধ্যেকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে বিআরআই’র কারণে নেপাল-ভারত সম্পর্কে একটি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। নেপালের অবকাঠামো, রাস্তা, বিমানবন্দর এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে চীনের বিনিয়োগের লক্ষ্য নেপালের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে শক্তিশালী করা এবং দুই দেশের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো। এই সংযোগের কারণে অর্থনীতি নিয়ে নেপালের ফোকাস চীনের দিকে চলে যেতে পারে এবং ভারতের উপর দেশটির নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারে। ভারত ঐতিহ্যগতভাবে নেপালের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং বিদেশী বিনিয়োগের প্রাথমিক উৎস। তবে চীনা বিনিয়োগের মাত্রা ও গতি নেপালে ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত নেপালের ওপর থেকে অর্থনৈতিক প্রভাব হারাচ্ছে এবং একইসঙ্গে নিজের নিকটবর্তী একটি রাষ্ট্রে চীনকে প্রভাবশালী খেলোয়াড় হয়ে উঠতে দেখছে।

চীন, নেপাল ও ভারতের মধ্যে আরেকটি উদ্বেগের ক্ষেত্র হচ্ছে পানি সম্পদ। ভারতে প্রবাহিত বেশ কয়েকটি প্রধান নদীর উৎপত্তি নেপালে। এ কারণে ভারতের কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য অত্যাবশ্যক পানির ওপর নেপালের উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু এখন নেপালের জলবিদ্যুৎ সেক্টরে চীনা বিনিয়োগের কারণে পানি কীভাবে পরিচালিত ও ভাগ হবে তার ধারণা প্রভাবিত হতে পারে। এতে ভারতে পানির প্রাপ্যতা কমতে পারে। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। হিমালয় অঞ্চলে এমন বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্পগুলি সেখানকার জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র ও এই প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল সম্প্রদায়ের জীবিকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।

চীন-নেপাল অংশীদারিত্বের কারণে সৃষ্টি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য ভারতের একটি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োজন। এটি ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ কমানোর পাশাপাশি নেপালের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখাও নিশ্চিত করবে। ভারতকে নেপালের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত হতে হবে, যেখানে নেপালের সার্বভৌমত্ব ও তার বৈদেশিক সম্পর্কের বৈচিত্র্যের অধিকারকে সম্মান করা হয়। একইসঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থও নিশ্চিত করতে হবে। সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) এবং বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে পারলে ভারত নেপালসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে গঠনমূলকভাবে জড়িত হতে পারবে। আঞ্চলিক সংযোগ, অর্থনৈতিক একীকরণ, জ্বালানি ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ স্থিতিস্থাপকতায় সহযোগিতামূলক উদ্যোগ এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে উত্থাপিত কিছু কৌশলগত চ্যালেঞ্জ প্রশমিত করতে সহায়তা করতে পারে।

চীন ও নেপালের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ভারতের জন্য কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বিস্তৃত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। যদিও এই চ্যালেঞ্জগুলি বেশ জটিল তবে এটি ভারতকে তার আঞ্চলিক কূটনীতি ও সম্পৃক্ততার পদ্ধতিকে পুনর্মূল্যায়ন করারও সুযোগ এনে দিয়েছে। পারস্পরিক সম্মান, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে নিজের কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে তা ভারতের জন্য তার অবস্থান ধরে রাখতে এবং একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ প্রতিবেশী নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

(স্ট্রেথিয়ায় প্রকাশিত অধ্যাপক আন্দ্রেয়া ফ্রান্সিওনির লেখা থেকে অনূদিত। তিনি ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর এশিয়ান স্টাডিজ’-এর সদস্য। বর্তমানে তিনি যেসব ইস্যু নিয়ে গবেষণা করছেন তার মধ্যে চীনের বৈদেশিক নীতি অন্যতম।)

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions