ডেস্ক রির্পোট:- সারা দেশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে কার্যক্রম চালিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশেরই নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন। অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চলে। অভিযান শেষে কিছুদিন বন্ধও থাকে। পরে আবার চালু হয়। কখনো অন্য নামে, কোথাও আবার ঠিকানা বদল করে। অদৃশ্য ক্ষমতার চাপে বন্ধ করা যায় না সব অবৈধ হাসপাতাল।
গত ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় শিশু আয়ান আহমেদ। এ ঘটনার পর হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ হাসপাতালের একটি তালিকা আদালতে জমা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই তালিকায় নাম রয়েছে ১ হাজার ২৭টি প্রতিষ্ঠানের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্য এক তালিকায় দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ২০৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬৩টি, বরিশাল বিভাগে ১৬২টি, রাজশাহী বিভাগে ৮৬টি, সিলেট বিভাগে ১৮টি, রংপুর বিভাগে ১২৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯৪টি এবং খুলনা বিভাগে ১১৬টি।
নিবন্ধনহীন এসব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধে ৬ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনও বলেছেন, ‘অবৈধ সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করা হবে। একটু সময় লাগবে। আমি নিজে এর সঙ্গে লেগে আছি।’
তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্যের বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যেই। একাধিক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈধতা দিতে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক মহল থেকে চাপ আসছে। এর আগে অবৈধ ক্লিনিক বন্ধের কারণে একজন পরিচালককে বদলি করা হয়। যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই এ নিয়ে কয়েক দিন আলোচনা হয়। তারপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।
২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় ১০ বছর বয়সী শিশু আহনাফ তাহমিন আয়হাম। ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিদর্শন দল গিয়ে দেখতে পায় ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স নিয়ে হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি তারা কখনো হাসপাতালের নিবন্ধনের জন্য আবেদনই করেনি। সেদিনই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ানের মৃত্যু ও মালিবাগের ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শিশু আয়হামের মৃত্যুর ঘটনা বেশ নাড়া দিয়েছে।
অবৈধ ক্লিনিক বন্ধে অভিযান শুরু হলেই বাড়ে ওপরের চাপ
৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি করা নির্দেশে নিবন্ধনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে অধিদপ্তরে জানাতে বলা হয়েছিল। বেঁধে দেওয়া সেই সময় শেষ হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। এই সময়ে কতটি অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ করা হয়েছে, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বন্ধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা লিখিতভাবে অধিদপ্তরে পাঠাবেন। সেটি আসার পর বলতে পারব কতগুলো বন্ধ হয়েছে।’
অবৈধ ক্লিনিক বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, জানতে অধিদপ্তরের তৈরি করা তালিকা ধরে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা অবৈধ হাসপাতালগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অনেক জায়গায় দিব্যি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবৈধ ক্লিনিকের তালিকায় থাকা এমন একটি প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইলের রেহেনা মডার্ন হসপিটাল। টাঙ্গাইল শহরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সামনেই গড়ে ওঠা ক্লিনিকের নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন। তারপরও দিব্যি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে থাকা অবৈধ এই হাসপাতাল।
রেহেনা মডার্ন হসপিটালের ১০০ গজের মধ্যে রয়েছে মেডিপ্লাস হসপিটাল অ্যান্ড হরমোন সেন্টার। কোনো হরমোন বিশেষজ্ঞ না থাকলেও ক্লিনিকের নাম হরমোন সেন্টার। এই কারণেই ক্লিনিকে রোগীর ভিড় কিছুটা বেশি। এখানকার বেশির ভাগ চিকিৎসকও শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের। কথা হয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়।
শুধু এই দুটি প্রতিষ্ঠানই নয়, টাঙ্গাইল শহরের সদর রোডে অবস্থিত আল-মদিনা চক্ষু হাসপাতাল অ্যান্ড ফ্যাকো সেন্টার, সাবালিয়ার টাঙ্গাইল মেডিপ্যাথ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাই কেয়ার ল্যাব, সুপার হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলথ এইড নামের ক্লিনিকও কোনো ধরনের আবেদন না করেই হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
অবৈধ ক্লিনিকের বিষয়ে জানতে গত বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইল সিভিল সার্জন কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর কক্ষে তালা ঝুলছে। এমনকি অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও সেখানে পাওয়া যায়নি। তবে শনিবার সিভিল সার্জনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, বন্ধের নির্দেশনা রয়েছে। ইউএনওদের সহযোগিতায় ইউএইচএফপিও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করবে।
এদিকে ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর মহল্লায় বহুতল ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে শাওন ডায়াগনস্টিক ল্যাব। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও এই ল্যাবে আসা রোগীদের অস্ত্রোপচার করা হয় তৃতীয় তলায় প্রতিষ্ঠিত মনির উদ্দিন প্রাইভেট হাসপাতালে।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল নিউ মনির উদ্দিন প্রাইভেট হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চিকিৎসক ছাড়া অস্ত্রোপচার করায় হাসপাতালটি সিলগালা করা হয়। এরপর নাম পরিবর্তন করে তিন মাস ধরে আবারও কার্যক্রম চালাচ্ছে অবৈধ এই প্রতিষ্ঠানটি।
যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজপত্র ঠিক না থাকায় সিলগালা করা হয়েছিল তখন।’
ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন নজরুল ইসলামও জেলায় অনুমোদনহীন হাসপাতাল থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নগরীতে অভিযান চালিয়ে এ মাসেই ২৫টি অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ করা হয়েছে।’
কুমিল্লা জেলায় ৫৭৩টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ১৩৭টির লাইসেন্স নেই।
ডেপুটি সিভিল সার্জন নাজমুল আলমও এ তথ্য স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ১৩৭ অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা ধরে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে আবেদন করে লাইসেন্স পাওয়ায় ৯টি প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়।
সাতক্ষীরা শহরে হাসপাতাল মোড় এলাকায় নিবন্ধন ছাড়াই চলছে শিমুল মেমোরিয়াল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান পলাশ জানান, ১০ শয্যার ক্লিনিকটি ২০০৭ সাল থেকে চলছে। অজ্ঞাত কারণে ২০১৭ সালের পর লাইসেন্স নবায়ন করা হয় না।
জেলার সিভিল সার্জন আবু সুফিয়ান রুস্তম বলেন, অভিযান চলছে। ক্লিনিক বন্ধের লোকবল নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এনে অভিযান পরিচালনা করতে হয়।
ফেনী জেলার ছয় উপজেলায় ১১৩টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই ৮১টির।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. শিহাব উদ্দিন জানান, নিবন্ধন না থাকায় শহরের মুক্তবাজার বায়েজীদ সাইকিয়াট্রিস্ট হাসপাতাল এবং ছাগলনাইয়া চক্ষু হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক বলেন, সারা দেশের হাজার হাজার বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লোকবল মাত্র ৮ থেকে ১০ জন। এ ছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের নেই নির্বাহী ক্ষমতা।
ফলে স্বাস্থ্য বিভাগ চাইলেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পরিস্থিতি উত্তরণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন করলে রোগব্যাধি কমে আসবে। এতে গজিয়ে ওঠা হাসপাতালগুলো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। হাসপাতাল পরিচালনার জন্য এসওপি তৈরি ও মানা বাধ্যতামূলক করতে হবে, লিগ্যাল ইস্যুস অ্যাড্রেস করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।আজকের পত্রিকা