বান্দরবান:- নানা রকম ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সামাজিক জীবনাচার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তবে সময়ের পরিক্রমায় বেশ কিছু ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। এ রকম একটি ভাষা হলো ‘রেংমিৎচা’। বর্তমানে এই ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র ছয়জন। আর তাদের সবার বয়স ৬০ থেকে ৭৪ বছরের মধ্যে। এই ছয়জনের মৃত্যু হলে একটি ভাষারও মৃত্যু ঘটবে, হারিয়ে যাবে সে ভাষার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গল্প। ‘রেংমিৎচা’ ভাষা জানা এ ছয়জনের বাস বান্দরবানে।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরত্বে আলীকদম উপজেলা। সেখান থেকে তৈনখাল হয়ে নৌকাযোগে দেড় ঘণ্টা উজানে গিয়ে রানীরঘাট নামক একটি ঘাটে নামার পর আবার সেখান থেকে ১ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয় দুর্গম এলাকা ক্রাংসিপাড়ায়। এখানে মাত্র ২৩টি পরিবারের বসবাস। জানা যায়, একসময় এখানে দেড় শর বেশি পরিবারের বাস ছিল। ক্রাংসিপাড়ার বয়স ৩০০ বছরের বেশি।
জানা যায়, ‘রেংমিৎচা’ ভাষী যে ছয়জন বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে তিনজন থাকেন এই ক্রাংসিপাড়ায়। মাংপুন ম্রো (৭৪) কুন রাও ম্রো (৬৯) এবং কুন রাও ম্রো (৬১)। এই ভাষা জানা আরেকজন মাংওয়াই ম্রো (৬০) থাকেন নাইক্ষ্যংছড়িতে ওয়াই বটপাড়ায়; থোয়াই লক ম্রো (৬৫) থাকেন আলীকদমের মেনচিংপাড়ায়, আর রেং পুন ম্রো (৬৫) আলীকদমের সাংপ্লপাড়ার বাসিন্দা। এদের মধ্যে দুজন নারী আর চারজন পুরুষ।
‘রেংমিৎচা’ জানা মাংপুন ম্রোর দুই ছেলে, সিংরা ম্রো এবং মেন রুম ম্রো। দুজনেই বাবার ভাষা বোঝেন কিন্তু বলতে পারেন না। ক্রাংসিপাড়ার মাংপুন ম্রোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বান্দরবানের এই অঞ্চলের রানীপাড়া, সাংতংপাড়া, কোয়া রাওপাড়া এবং বোন চুপাড়ার সবাই ‘রেংমিৎচা’ ভাষা জানতেন। একেকটি পাড়াতে ৬০-৮০টি পরিবার ছিল, তারা ‘রেংমিৎচা’ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানতেন না। তাই এসব এলাকায় অন্য এলাকা থেকে লোকজন গেলে এই ভাষা জানা মানুষকে দোভাষী হিসেবে সঙ্গে নিতেন। ৪০-৫০ বছর আগে তাদের কেউ কেউ মায়ানমার বা ভারতে চলে যান, বাকিরা মূল ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যান। ম্রো ভাষার সঙ্গে ‘রেংমিৎচা’র মাত্র ১০ শতাংশ মিল রয়েছে। এভাবেই দিন দিন প্রাচীন এই ভাষাটির লোকজন কমে গিয়ে চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে।
‘রেংমিৎচা’ ভাষায় গান, কবিতা, গল্প আছে কি না, জানতে চাইলে মাংপুন ম্রো বলেন, ‘গান শুনিনি, তবে ছন্দ মিলিয়ে কবিতার মতো শুনেছি। এ ছাড়া এই ভাষায় অনেক রূপকথার গল্প আছে।’
এ পাড়ার আরেক বাসিন্দা ‘রেংমিৎচা’ ভাষী কোনরাও ম্রোর দুই মেয়ে, এক ছেলে। কেউই এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না। সিংরা ম্রো (৪৪) জানান, তিনি ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শুধু ‘রেংমিৎচা’ ভাষাই জানতেন। কারণ বাড়িতে সবাই এ ভাষাতে কথা বলতেন। দাদা ওয়ালক ম্রো মারা যাওয়ার পর বাড়িতে আর তেমন এই ভাষা চর্চা হয় না। নিজেও বিয়ে করে বাবার বাড়ি থেকে আলাদা হওয়ার কারণে ভাষাটি চর্চা করা হয়ে ওঠেনি।
ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি গ্রন্থের লেখক, বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য সিংয়ং ম্রো জানান, ‘রেংমিৎচা’ জানা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ২০১৩ সালে ৩৬ জনকে পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে সাবলীলভাবে বলতে পারা মানুষের সংখ্যা ছয়জনে নেমে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডর্টমুন্ড কলেজের অধ্যাপক ডেডিভ এ কে পিটারসন ১৯৯৯ সালে খুমি ও ম্রো ভাষা নিয়ে গবেষণা করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৭০ সালের দিকে লেখা লরেন্স জি লোফলার নামের এক জার্মান ভাষাবিদের বই থেকে ‘রেংমিৎচা’ ভাষার কথা জেনেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে ডেভিডের গবেষণা সহযোগী ছিলেন ইয়াংঙান ম্রো। সে সময় ডেভিড ও ইয়াংঙান ‘রেংমিৎচা’ ভাষা বলতে পারা ২২ জনকে খুঁজে বের করেন। ডেভিড চলে যাওয়ার পরও কাজটি চালিয়ে যান ইয়াংঙান ম্রো। পরে আরও ১০ জনকে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। তবে ওই ৩২ জন মধ্যে বিভিন্ন সময় মারা যাওয়ার পর রেংমিৎচা ভাষী এখন মাত্র ছয়জন জীবিত রয়েছেন।খবরের কাগজ