ডেস্ক রির্পোট:- সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে গত ১৫ বছরে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণকাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ক্রসবার বাঁধ নির্মাণ করেছে নয়টি, স্পার নির্মাণ করেছে পাঁচটি। এসব প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে ২ হাজার ৮৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবু ভাঙন ঠেকানো যায়নি। স্থানীয়রা জানান, কাজিপুর, সদর, বেলকুচি ও শাহজাদপুর উপজেলা, এনায়েতপুর থানা ও চৌহালী উপজেলার বিভিন্ন অংশ প্রতি বছর কমবেশি নদীতে ভাঙছে।
সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটার যমুনা নদী বহমান। বঙ্গবন্ধু সেতুর গাইডবাঁধ যমুনা নদীর ভাঙন থেকে ঝুঁকি মুক্ত রাখতে ক্যাপিটাল (পাইলট) ড্রেজিং অব রিভার সিস্টেম ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালে নদীর গতিপথ স্থানান্তর করা হয়। ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে ৪ কিলোমিটার এবং ভাটিতে সাড়ে ৩ কিলোমিটার নদী খনন করা হয়। পাউবোর এ প্রকল্পের ফলে কাজিপুরের মাইজবাড়ী, মেঘাই, খুদবান্দি, সিংড়াবাড়ী ও শুভগাছা, সদর উপজেলার বাহুকা, সিমলা, শৈলাবাড়ী ও খোকশাবাড়ী ও ভাটপিয়ারী এলাকায় নদী ভাঙন অনেকটা রোধ হয়েছে। তবে শাহজাদপুর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে হাটপাঁচিল পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গত আট বছরে শত শত মানুষ বাড়িঘর ও ফসলিজমি হারিয়েছে। এছাড়া চৌহালী উপজেলার খাসপুকুরিয়া থেকে চর সলিমাবাদ পর্যন্ত যমুনা তীর প্রতি বছর ভাঙছে।
তবে এরও আগে ১৯৯৯ সালে ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পৌনে তিন কিলোমিটার সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধ (হার্ডপয়েন্ট) নির্মাণ করে পাউবো। এখন পর্যন্ত এই বাঁধটিকে টেকসই মনে করা হলেও এতেও কয়েকবার ধস দেখা গেছে।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণ গ্রামে গেলে কথা হয় স্থানীয় প্রবীণ আব্দুর রহমানের (৮৫) সঙ্গে। তার বসবাসের ঘরটি জীর্ণ। টিনের ছাপড়াঘর। শোলার বেড়া। কিছু জায়গায় কাপড় দিয়ে আড়াল করা। এর মধ্যেই স্ত্রী সালেহা বেগমকে (৮০) নিয়ে বাস করছেন আব্দুর রহমান।
আব্দুর রহমান জানান, তার বাড়ি ছিল যমুনার পূর্বপাড় চৌহালির স্থল ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে। সেখানে নদীভাঙনের কবলে পড়ে বসতি গড়েন চর সনাতনী গ্রামে। সেখানেও ছয় বিঘা জমি ও বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়। এভাবে সাতবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে ৩০ বছর আগে নিঃস্ব হয়ে চলে আসেন এনায়েতপুরে। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায় কোনো রকমে ঠাঁই নেন। এর পরে জায়গা ক্রয় করে প্রায় ১৫ বছর ধরে বসতি স্থাপন করেছেন এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগ্রামে। সেই সময়ে ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে যমুনা নদী ছিল প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু গত ১০ বছরে এই এলাকায় নদী ভাঙছে। ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে শাহজাদপুর উপজেলার পাঁচিল পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় নদীভাঙনে শত শত বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমিসহ বহু স্থাপনা বিলীন হয়েছে। এখানেও আব্দুর রহমান দুবার ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হঠাৎ আব্দুর রহমানের বাড়ির উঠোনের সামনের অংশ নদীতে বিলীন হয়েছে। তার অন্য ছেলেদের ভিটা নদীতে ভেঙেছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে আব্দুর রহমানের ভিটার বাকি অংশ আর রক্ষা হবে কিনা আশঙ্কা রয়েছে। তার মতো এই এলাকার শত শত মানুষ এখন নদীভাঙন আতংকে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৮ সালে রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে ২১৭ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করে পাউবো। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ অংশে রয়েছে প্রায় ৮০ কিলোমিটার। প্রতি বছর যমুনা নদী দিয়ে প্রায় ১২০ কোটি টন পলি প্রবাহিত হয়। এ কারণে নদীর বুকে ছোট-বড় অসংখ্য চর জেগে ওঠে। বর্ষাকালে গড়ে পানিপ্রবাহ থাকে প্রায় ৪০ হাজার কিউসেক। এ সময় নদী বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। ফলে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দেয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে ভাঙনের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে। নদীতে বিলীন হয়েছে বাড়িঘর, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, রাস্তা, হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
পাউবো জানিয়েছে, চৌহালীর ঘোরজান, বাঘুটিয়া, উমারপুর, খাষ পুকুরিয়া এলাকায় ভাঙন রোধে ২০১৩-১৪ সালে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি ব্লক দিয়ে নির্মিত প্রায় আট কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বিনানই থেকে চরসলিমাবাদ, ভূতের মোড়, সম্ভুদিয়া, চৌবারিয়া, বাঘুটিয়া ও পয়লা এলাকায় ভাঙন রোধে ১০ বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। একইভাবে শাহজাদপুর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে হাটপাঁচিল পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় গত ১০ বছরে ভাঙন রোধে ২৫ কোটি টাকার জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক এসএম মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পরিকল্পনাহীন বাঁধ নির্মাণ বা নদী শাসন করলে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। নদীর যেখানে-সেখানে বাঁধ, ক্রসবাঁধ নির্মাণ বা যেখানে নদী ভাঙবে সেখানেই বাঁধ নির্মাণ বোধহয় ঠিক নয়। নদীর চলমান প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। নদীতীর রক্ষায় পরিকল্পনামাফিক বাঁধ নির্মাণ বা প্রকল্প নেয়া উচিত। তাহলে নদীভাঙন থেকে যেমন মানুষ মুক্তি পাবে, পাশাপাশি নদীতীরের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে।’
পাউবো সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, যমুনা নদীর গতি প্রকৃতি বুঝে ওঠা কঠিন। কখন কী রূপ নেয়, তা বলা যায় না। তার পরও পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চলমান। তিনি বলেন, ‘নদীভাঙন রোধে এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে শাহজাদপুরের পাঁচিল পর্যন্ত সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ কাজ চলমান। বাঁধটি নির্মাণ শেষ হলে এই এলাকায় আর ভাঙন থাকবে না। এছাড়া নদীভাঙন রোধে চৌহালীর খাসপুকুরিয়া হতে চর সলিমাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদীর তীর রক্ষায় ৪৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেয়া হয়েছে।’