যৌন কেলেঙ্কারিতে উত্তপ্ত ৪ বিশ্ববিদ্যালয়

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১৩৯ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- দেশের শীর্ষ ৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা। যৌন হয়রানি ও কেলেঙ্কারির ঘটনায় উত্তপ্ত ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন এক ছাত্রী। এ ঘটনার বিচার দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরই প্রেক্ষিতে ওইদিন রাত থেকেই বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে শাস্তি চেয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে।

শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠা শিক্ষক নাদির জুনায়েদকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নাদির জুনায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।

গতকাল বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবুল মনসুরের কাছে রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে আসা চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। যেখানে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ তাকে সবধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নিমিত্তে ৩ মাসের ছুটিতে থাকবেন নাদির জুনায়েদ।

চিঠিতে পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠনসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ার কথাও জানানো হয়।

গত ১০ই ফেব্রুয়ারি নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। দেড় বছর ধরে এই শিক্ষকের দ্বারা যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছেন বলে ওই শিক্ষার্থী প্রক্টর বরাবর দেয়া লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন।

এরপরই এই শিক্ষকের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ব্যাপক আন্দোলন বিক্ষোভে নামে। মানববন্ধন, মশাল মিছিল, অভিযুক্ত শিক্ষকের রুমে তালা দেয়ার পর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা তার শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন।

গতকাল ওই শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে দ্বিতীয় দিনের মতো বিভাগের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা নাদির জুনায়েদের কক্ষ ও বিভাগের ৪টি কক্ষে তালা দিয়ে ভিসি কার্যালয়ের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় তারা ভিসি অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামালকে তিনদফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি দেন। সেখানে তাদের অবস্থানের মুখেই অধ্যাপক নাদিরকে ৩ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাদির জুনায়েদ। যৌন হয়রানির অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলেও দাবি করেছেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন: বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংলগ্ন জঙ্গলে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ মাদকের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়াসহ পাঁচদফা দাবিতে আন্দোলন করছেন। গতকাল নতুন প্রশাসনিক ভবন প্রতীকী অবরোধ করা হয়। সকাল ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ‘নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চ’-এর ব্যানার থেকে এ অবরোধ করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: গত ৩১শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষার্থী একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুবুল মতিনের বিরুদ্ধে। এতে তিনি লেখেন, থিসিস চলাকালীন আমার সুপারভাইজার কর্তৃক যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হই। থিসিস শুরুর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে বিভিন্ন যৌন হয়রানিমূলক; যেমন- জোর করে হাত চেপে ধরা, শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করা, অসঙ্গত ও অনুপযুক্ত শব্দের ব্যবহার করা। কেমিক্যাল আনাসহ আরও বিভিন্ন বাহানায় তিনি আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক জাপটে ধরতেন। এরমধ্যে গত ১৩ই জানুয়ারি আনুমানিক ১২টা নাগাদ কেমিক্যাল দেয়ার কথা বলে রুমে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার পক্ষে দৈনন্দিন ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টার এই অভিযোগ ওঠার পর এর প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলন করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বিচারের দাবিতে গত ৩১শে জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড নিয়ে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।

গতকাল অভিযুক্ত ওই শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার না করা পর্যন্ত এ আন্দোলন চলমান থাকবে বলে জানান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আশ্বাস দিলেও মাঠে থেকেই বিচার নিশ্চিত করতে চান তারা। আন্দোলনের বিষয়ে রসায়ন বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম বলেন, আমরা ওই শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য ৯ দিনের মতো আন্দোলন করছি। আমাদের বোনকে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণচেষ্টার মতো জঘন্য ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে এরকম নিকৃষ্ট কাজ কেউ করার চিন্তাও মাথায় না আনে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরবো না। তাকে যদি শাস্তি না দেয়া হয় আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো।

এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করেছে। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. জরিন আখতার। আজ কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে চবি ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার বলেন, তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় দিনরাত কাজ করছে। তদন্ত কমিটি প্রতিনিয়ত বৈঠক করে যাচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তাদের তদন্ত চলমান রয়েছে।

বাকৃবি শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানি: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) প্রতিনিধি মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর জানান, গত ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল জব্বারের মোড় হতে শাহজালাল পশুপুষ্টি মাঠ গবেষণাগার সংলগ্ন রাস্তায় শ্লীলতাহানির শিকার হন পশুপালন অনুষদের এক নারী শিক্ষার্থী। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এক সিএনজিচালক পেছন থেকে এসে অশালীনভাবে ওই নারী শিক্ষার্থীর গায়ে হাত দেয়। সেই সময়, তার সিএনজিতে কোনো যাত্রী ছিল না। পরবর্তীতে, সেই সিএনজিচালককে ধরতে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরদিন শ্লীলতাহানির বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন পশুপালন অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করে গালিগালাজ করে। এর প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ পত্র জমা দেন।

ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির দু’দিনের মধ্যেই শ্লীলতাহানিকারী সিএনজিচালক মো. মোশারফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানা পুলিশ। গতকাল দুপুরের দিকে ময়মনসিংহের পাটগুদাম এলাকা থেকে অভিযুক্তকে আটক করা হয়। সে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার নাটেরকোনা গ্রামের বাসিন্দা।

অভিযুক্তকে আটকের পরই বাকৃবি ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা পুনরায় স্ব স্ব পদে কাজ শুরু করেছেন। এ বিষয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের বিষয়টি জানার পরই আমাদের সকল বিভাগকে অবহিত করে। সকলের সহযোগিতায় আমরা দ্রুত সময়ে ময়মনসিংহের পাটগুদাম এলাকা থেকে অভিযুক্তকারীকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। এখন মামলার প্রস্তুতি চলছে। পরে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। মানবজমিন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions