ডেস্ক রির্পোট:- বাস্তবতার নিরিখে মোটাদাগে চার কারণে ধীরে চলছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। এগুলো হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা, রোজা, মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের মুক্ত না হওয়া এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব কারণে আগামী কয়েক মাস বড় বা লাগাতার কর্মসূচিতে থাকছে না বিএনপি ও মিত্ররা। তবে এই সময়ের মধ্যে জনস্বার্থ বিভিন্ন ইস্যুতে ধারাবাহিক কর্মসূচি থাকবে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও নাগরিক দুর্ভোগ-হয়রানির প্রতিবাদসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজপথে সোচ্চার থাকবে বিএনপি। সেইসঙ্গে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে মূল দলসহ অঙ্গসংগঠনগুলোও গোছাতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি রোজার মাসে কয়েকটি ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হবে। তা ছাড়া আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের আন্দোলন শেষ হয়নি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে তারা আন্দোলনেই আছেন। তবে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে যে, জুনের পর থেকে বড় আন্দোলনের কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগামী ১৭ জুন ঈদুল আজহা হতে পারে। এরপর থেকে বিএনপি বড় ধরনের আন্দোলন নিয়ে মাঠে যেতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎভাবে লাগাতার আন্দোলনে নামে বিএনপি। মূলত ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পর থেকে একদফা দাবিতে টানা হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটগুলো। কিন্তু এই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি তারা। একপর্যায়ে গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপিসহ ৬২টি রাজনৈতিক দল। অবশ্য বিএনপি ও মিত্রদলগুলোর নেতাকর্মীদের দাবি, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমনপীড়ন উপেক্ষা করেও তারা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সফলভাবে পালন করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ জানুয়ারি দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে বর্জন করেছেন। ফলে এটিই তাদের সাফল্য। কিন্তু সরকার ও তার অনুগত নির্বাচন কমিশন গায়ের জোরে বলছে ৪১.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। সরকার যাই বলুক, গণতান্ত্রিক বিশ্ব ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনকে ‘স্বীকৃতি দেয়নি’।
দলীয় সূত্র বলছে, মূলত চারটি কারণে ধীরে চলছে বিএনপি। এগুলো হচ্ছে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে ২০২৪ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা, যা ১২ মার্চ শেষ হওয়ার কথা। ওইদিন বা তার পরদিন (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে) থেকে শুরু হবে পবিত্র রমজান। রোজা শেষে ১০ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে যে কোনোদিন অনুষ্ঠিত হবে ঈদুল ফিতর। এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা এখনো কারাগারে বন্দি। তাদের মুক্তির বিষয়টিকে এখন প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি। ওদিকে মার্চেই হচ্ছে কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আগামী মে মাসে শুরু হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। বিএনপি স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে এখনো নতুনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। মূলত এসব কারণেই আপাতত মাঠের বড় কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি ও মিত্ররা। তবে এই সময়ে তারা মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের অভাব, নাগরিক হয়রানির ঘটনাসহ জনস্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মাঠে থাকবে। একইসঙ্গে নতুন কোনো ঘটনা সামনে এলে তা নিয়ে তাৎক্ষণিক কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে আমরা চলমান আন্দোলনে আছি। আন্দোলনের গতি একেক সময় একেক রূপ নেয়। আপনারা অপেক্ষা করুন… নিশ্চয়ই আমাদের আন্দোলনে দেখতে পাবেন। তিনি বলেন, বিএনপিসহ সমমনা ৬২টি রাজনৈতিক দল ৭ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ও যৌক্তিক ছিল। বিএনপির আবেদনে সাড়া দিয়ে, নির্বাচন বর্জন ও ফল প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জনগণ প্রমাণ করেছে যে, বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান গণআকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। বিএনপির সঙ্গে একত্র হয়ে গণমানুষের এই নীরব প্রতিবাদ ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন সত্যিকার অর্থে বিএনপির রাজনীতির সফলতা তথা বিজয়ের বহিঃপ্রকাশ।
বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, আন্দোলন-কর্মসূচির ফাঁকে ফাঁকে সংগঠন গোছানোর কাজ করবে বিএনপি। সে লক্ষ্যেই গত ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এখন অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিও পুনর্গঠন করা হবে। পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এখনো দলের অনেক নেতাকর্মী কারাবন্দি আছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলনের কর্মসূচি আমরা তো শেষ করিনি। নতুন কর্মসূচির বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি বলেন, সরকারের অব্যাহত দমন-পীড়নে অনেক নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। অসংখ্য নেতাকর্মী এখনো কারাগারে বন্দি। তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অবর্ণনীয় নির্যাতন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগঠন গোছানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। আন্দোলন ও দল পুনর্গঠন একসঙ্গেই চলবে। এর পুরো বিষয়টি দেখছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার নেতৃত্বেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। আর উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে দলের নতুন সিদ্ধান্ত নেই বলে জানান রিজভী।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, একদফা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল ঘরে তুলতে না পারার পেছনে বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতা অন্যতম একটি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষনেতা অনেকেই এখনো কারাবন্দি রয়েছেন। মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কেন্দ্রসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে কিছুটা হতাশও তৈরি হয়। বিশেষ করে আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা-মামলায় জর্জরিত হন বিভিন্ন দলের হাজারো নেতাকর্মী। অসংখ্য নেতাকর্মীকে নিজের বাসাবাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। ফলে কর্মসূচি পালনে কিছুটা হলেও তাদের মাঝে অনীহা তৈরি হয়। এহেন পরিস্থিতিতে আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়নে তাড়াহুড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না বিএনপির হাইকমান্ড। অতীতের ভুলক্রটিসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে শিগগির পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে চান তারা। সবকিছু গোছাতে একটু সময় লাগতে পারে।
অবশ্য বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন সফল হয়েছে দাবি করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ৭ জানুয়ারি দেশে কী নির্বাচন হয়েছে তা দেশবাসী শুধু নয়—বিশ্ববাসীও দেখেছে। খেয়ে না খেয়ে তিন দিন আগেই বিএনপির প্রতিটা সভা-সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের জমায়েত কি গণঅভ্যুত্থান নয়? আমাদের তো অস্ত্র নেই যে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করব? তবে এই সরকারের শেষ রক্ষা হবে না। কালবেলা