ডেস্ক রির্পোট:- শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হলেও আদতে আনুপাতিক হারে তা বাড়ে না। উল্টো যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, অর্থবছরের মাঝপথে এসে তা আরও কমিয়ে দেওয়া হয়। এবারও একই কাজ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মাঝপথে এসে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৫৮টি প্রকল্পের বিপরীতে ১৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সংশোধিত এডিপি থেকে ৮ হাজার ৫৬০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৫৩৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ১১.৬৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং এর আগের অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ।
জানা গেছে, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুস সালামের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় প্রাথমিকভাবে সংশোধিত এডিপির অনুমোদন দেওয়া হবে। এর পরে চতুর্থ সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এটি চূড়ান্ত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই সভা হবে।
কয়েক বছর ধরেই বাজেটে অন্যান্য খাতের তুলনায় শিক্ষায় গুরুত্ব কমে আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও একই ধারা অব্যাহত থাকায় হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও আমাদের দেশে আসলেই তেমন অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে যেভাবে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ হয়, আমরা তার ধারেকাছেও নেই।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মোট ছয়টি সংস্থার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বরাদ্দ থেকে সবচেয়ে বেশি কমানো হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে ব্যানবেইসের বরাদ্দ। একই সঙ্গে আরএডিপিতে থোক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
আরএডিপি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ৩১টি প্রকল্পের আওতায় এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আরএডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা পাঁচটি বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৬টিতে। তবে বরাদ্দ ৩ হাজার ৪৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা কমে দাঁড়াচ্ছে ২ হাজার ৫৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
অর্থ ছেঁটে ফেলার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের ১৪টি প্রকল্পের আওতায় এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ১৬৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬টিতে। তবে বরাদ্দ ২ হাজার ৯৮৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা কমে দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ১৮৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ৮টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এ বিভাগের বরাদ্দ ১ হাজার ২৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকা কমে দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাংলাদেশ স্কাউটসের এডিপিতে ৩টি প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ রয়েছে ৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আরএডিপিতে বরাদ্দ ১৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা কমে দাঁড়াচ্ছে ২৪ কোটি ৯ লাখ টাকা।
মাউশির উন্নয়নে এডিপিতে থোক বরাদ্দ ছিল ৮৯৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। তবে আরএডিপিতে কোনো থোক বরাদ্দ থাকছে না। তবে বাড়ছে ব্যানবেইসের বরাদ্দ। ব্যানবেইসের দুটি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এডিপিতে তাদের বরাদ্দ ১০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকায়।
শিক্ষায় ব্যয় কমালে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইমেরিটাস ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মনজুর আহমে বলেন, বাজেট বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে না। তার প্রমাণ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ কমানো। পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে যেভাবে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ হয়, তার ধারেকাছেও নেই আমরা। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদেরও ব্যর্থতা রয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ না বাড়লে শিক্ষার মান বাড়বে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা থাকলে আমাদের দেশে তা অনেক কম। তার ওপর যদি এডিপি থেকে বরাদ্দ কমানো হয়, তা হলে এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার মতে, শিক্ষায় উন্নয়নের জন্য নেতৃত্বেরও উন্নয়ন দরকার। কারণ, যেটা বরাদ্দ থাকে সেটাও সঠিকভাবে ব্যয় হয় না। যতটুকু ব্যয় হয়, তাতে গুণগত মানে উন্নতি দেখছি না। তার মানে ওই ব্যয়টাও কাজে লাগছে না।
করোনায় স্কুলগুলোর শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে খরচ বাড়ানোর কথা বললে তারা তা আমলে নেয়নি। পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। শিক্ষকদের মান এবং দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। যেটা খরচ হয়, তা দিয়ে মানের উন্নয়ন হচ্ছে না। এটা এক ধরনের অদক্ষতা বলা যায়। যেভাবে খরচ করা হয়, তা কাজে লাগে না। ব্যয়ের ধরন পরিবর্তন দরকার। অর্থাৎ শিক্ষার উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করতে হবে।কালবেলা