টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে ২০১৮ সালেই রেকর্ড গড়েছিল আওয়ামী লীগ। চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নতুন নজির সৃষ্টি করেছিলেন শেখ হাসিনা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ও তার সভাপতি। গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বেসরকারি ফলে ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২২৫টিতেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২২৩ আসন পেয়েছে। আর ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ জিতেছে ১টি করে। এই নির্বাচনে বড় চমক দেখিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সব মিলিয়ে ৬১টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন তারা। বড় বিপর্যয় হয়েছে গত দুটি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির। তাদের আসন সংখ্যা ১১টিতে নেমে এসেছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে আসা কল্যাণ পার্টি জিতেছে একটি আসনে। তবে বিএনপির দলছুটদের নিয়ে গঠিত নতুন দল তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম অনেক আশা নিয়ে নির্বাচন করলে তাদের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। বিএনপিসহ ১৬টি নিবন্ধিত দলের বর্জনের মধ্যেই রোববার অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচন আগেই বাতিল করা হয়েছিল। এ ছাড়া ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের জেরে ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের একটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল হওয়ায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভোটের পার্থক্য ওই কেন্দ্রের মোট ভোটারের চেয়ে কম থাকায় এ আসনের ফল স্থগিত রয়েছে। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের ডাকা হরতালের মধ্যে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট গ্রহণ চলে। কোনো কোনো আসনে বিচ্ছিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষ, জাল ভোট, এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ কিছু অনিয়ম সত্ত্বেও সার্বিকভাবে ভোটের পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। তবে কেন্দ্রগুলোতে কম ভোটার উপস্থিতি নিয়ে দিনভর আলোচনা ছিল দেশজুড়ে। কোথাও কোথাও মাইকিং করেও ভোটারদের কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানাতে দেখা যায়। সকাল ৮টায় সারা দেশে ভোট গ্রহণ শুরুর তিন ঘণ্টা পরও রাজধানীসহ অধিকাংশ কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার হার কোথাও ছিল ৩ শতাংশ, কোথাও ৫ কিংবা কোথাও ৮ শতাংশ। দিন শেষে নির্বাচন কমিশন জানায়, সারা দেশে ভোটার উপস্থিতির গড় হার ছিল ৪০ শতাংশ। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সরকারের সহযোগিতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।
নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সরকারের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। এক. অভ্যন্তরীণ; দুই. আন্তর্জাতিক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতা ও রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ
Remaining Time -20:13
করতে হবে। তা ছাড়া নির্বাচন ঘিরে দলের মধ্যে
যে কোন্দল ও গ্রুপিং চলছে, বিশেষ করে স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থীর মধ্যে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকেও সমাধান করে দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নতুন সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২৪ সালের সরকারের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৬ শতাংশ, ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ শতাংশে। জুলাই-আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ শতাংশের ওপর। যার প্রভাব এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এটি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সাধারণ ও নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করা মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে সরকার মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে, যাতে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে।
ডলারের সংকট নিরসন ও দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা নতুন সরকারের আরও একটি বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার দাম বেড়ে যাওয়া গত বছর ব্যাপক প্রভাবিত করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ জুন থেকে এখনো পর্যন্ত গত দেড় বছরে টাকার তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, যার প্রভাবে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করায় সাধারণ মানুষকে ক্রয় করতে হয়েছে বেশি টাকার বিনিময়ে। অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান সুদের হারের মতো বিনিময় হারও একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থার মধ্যে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। যাতে আগামীতে বিনিময় হারে অস্থিরতা কমে আসে। সরকারকে এ ক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা নতুন সরকারের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত এক বছর বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত জানুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২.২২ বিলিয়ন ডলার, যা ডিসেম্বরে এসে পৌঁছেছে ২১ বিলিয়ন ডলারে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণসহ অন্যান্য উৎস থেকে ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত অর্থ, আইএমএফের এসডিআর খাতে থাকা অর্থ, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ এবং আকুর বিল পরিশোধ বাবদ অর্থ হিসেবে নিলে রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমবে বলে বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হতে পারে রপ্তানি আয় পুরোপুরি দেশে ফিরে না আসা, যা এরই মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং (কোনো পণ্যের আসল দামের চেয়ে বেশি দাম দেখানো), ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে অনেক টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ নজরদারির দায়িত্বে থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আরও কঠোর হতে হবে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশ কোন দিকে যাবে তা নিয়ে আশা আর প্রত্যাশার সঙ্গে সারা দেশের মানুষ শঙ্কা আর সম্ভাবনার দোলাচলে রয়েছে। রাজনীতি আর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে স্বস্তি ফিরবে নাকি সংঘাত-সংকটে আরও জর্জরিত হবে তা এখনই কেউ হলফ করে বলতে পারছে না। তবে আমরা নতুন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,নটর ডেম কলেজ, ঢাকা