ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য:- বেশ কিছুদিন ধরে ত্রিমুখী সংকটে রয়েছে দেশ। রাজনীতি, অর্থনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্ক– এই তিন সংকট আরও গভীর হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। এ রকম একটি সময়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন সময়টা বড় চিন্তার।
রাজনৈতিক সংকট দিয়েই শুরু করি। সাম্প্রতিককালে মৌলিক রাজনীতির দুটি সমস্যা রয়েছে বলে আমার মনে হয়। প্রথম সমস্যা হলো সরকারের বৈধতার। সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা থাকলেও যদি রাজনৈতিক এবং নৈতিক বৈধতা না থাকে, তাহলে দেশের জন্য সর্বাপেক্ষা কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব হয় না। আরেকটি সমস্যা হলো গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব। যেহেতু বৈধতা নেই সেহেতু সব পর্যায়ে জবাবদিহি দাবি করা যাচ্ছে না। এ ধরনের অবস্থায় সমঝোতায় যেতে হয়। নিজস্ব আদর্শের বিরোধীদের সঙ্গেও আপস করতে হয়। জবাবদিহির অভাবে বাজারে সিন্ডিকেটের কথা বলা হলেও তা থামানো যাচ্ছে না। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।
নির্বাচনের প্রসঙ্গে আসি। নির্বাচনের যে পথরেখা দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের মৌল সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচন হলেও হতে পারে, কিন্তু তাতে আমি বৈধতা ও জবাবদিহির সমস্যার সমাধান দেখি না।
মৌলিক সমস্যা সমাধানে যত দেরি হবে, দেশকে তত মূল্য দিতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দরকার; যে বৈদেশিক সমর্থন দরকার; যে অর্থনৈতিক সংস্কার দরকার; তার জন্য শুধু একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বিষয় নয়। প্রয়োজন এমন একটি নির্বাচন, যার মাধ্যমে সাংবিধানিক বৈধতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতায়ও ফিরে আসবে। শেষ বিচারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠাই আসল বিষয়। কম-বেশি হলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে হবে। মানুষের চেতনার মধ্যে আসতে হবে। পেশাজীবীদের এবং একই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন লাগবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এর বিকল্প নেই।
বিরোধী দলের এখন আরেকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়; লড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে। তাদের টিকে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে। একদিকে বলা হচ্ছে, আলোচনা করতে অসুবিধা নেই; অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাদের ঢালাও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একজনকে খুঁজতে এসে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে বলা হচ্ছে, সে অপরাধ স্বীকার করেছে। তাকে কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে স্বীকার করানো হচ্ছে; সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। এই ভীতির পরিবেশ হয়তো জনমতের দৃশ্যমান ব্যাপক প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ রকম ব্যবস্থায় ও পরিবেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিবেচনার পরিবেশ সৃষ্টি করে না। এভাবে নির্বাচন অর্থবহ করা যায় না। দেশের ৮০ শতাংশের ওপরে মানুষ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দিতে চায়। কিন্তু বহুলাংশ মনে করে, বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়। ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূল ব্যবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মূল্যস্ফীতির কথাই আগে আসে। মূল্যস্ফীতি সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকারি হিসাবেই যা ১০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে খাদ্য মূল্যসূচক এর চেয়ে অনেক বেশি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। লক্ষণীয় বিষয়, গ্রামে মূল্যস্ফীতি শহরের চেয়ে খানিকটা বেশি। মূল্যস্ফীতি নিকট মেয়াদে কমবে বলে মনে হয় না। কারণ, টাকার দাম কমার প্রবণতা রয়েছে, যা আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করবে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও মূল্যস্ফীতি কমানোর পথে যা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
অর্থনীতির আরেকটি সংকট হলো সরকারের আয় ও ব্যয় দুটোই কমে যাওয়া। এর ফলে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারছে না। রাজস্ব ব্যয় করতেও টাকার সমস্যায় পড়ছে। নির্বাচন সামনে রেখেও গ্রামে সরকার যেসব কাজ করতে চায়, সেগুলোও ঠিকমতো হচ্ছে না। সরকারি বিনিয়োগ যেহেতু কমে গেছে, ব্যক্তি বিনিয়োগও কমেছে। উদ্যোক্তারা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারছে না।
একই সঙ্গে সরকারের ঋণজনিত ব্যয় বিশেষত স্বল্পমেয়াদি দায় বেড়ে গেছে। এর পাশাপাশি কিছু বড় প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের সময় হয়ে গেছে। কর্ণফুলী টানেল চালুর আগেই ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ আগামী দুই বছর পর শুরু হবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ আগামী কয়েক বছরে ন্যূনতম ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে বাড়বে। এই বর্ধিত ঋণ পরিশোধে আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। সরকার আইএমএফসহ বিভিন্ন উৎস থেকে যেসব বাজেট সহায়তা নিচ্ছে, তার জন্যও পরিশোধের বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। সরকার এখন এক অর্থে ঋণ করে ঋণ পরিশাধ করছে।
আমাদের রেমিট্যান্স ও রপ্তানির জায়গায় যে শক্তি ছিল, তা টাকার বিনিময় হারসহ বিভিন্ন নীতির কারণে দুর্বল হয়েছে। যথাযথ মনোযোগ দিলে সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা এত করুণ হতো না। সরকার এখন অর্থনীতিকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিবেচনাহীন এবং সমন্বয়বর্জিত ব্যবহার অর্থনীতিতে চলে না।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছুটা হলেও ইউেরাপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে ধরনের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার একটা বড় জায়গা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। আরেকটি জায়গা শ্রম অধিকার এবং শ্রমের পরিবেশ। এর সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। একই সঙ্গে এসব দেশ তাদের দেশে অন্যদেশ থেকে আসা নোংরা অর্থ প্রতিহত করার বিষয়েও তৎপর হয়ে উঠছে। আগামীতে আসবে পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়। পরিবেশ, নারীর অধিকার, শ্রমের অধিকার এবং তার সঙ্গে মানবাধিকার চক্রাকারে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট সরকারের ভেতরে কাজ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার নিয়ে একটি মেমোরেন্ডাম অনুমোদন করেছে। শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে।
অনেক সময় বলা হয়, ইরান, মিয়ানমার, ভেনেজুয়েলা, বেলারুশের মতো দেশ মার্কিন তথা বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা নিয়েও তো চলছে। তবে এসব দেশের প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। মিয়ানমার যতক্ষণ চীন এবং রাশিয়া আছে, ততক্ষণ অন্য দেশ নিয়ে চিন্তা করে না। বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়া থাকলে সে অন্য কিছু চিন্তা করে না। ইরান ও ভেনেজুয়েলা তাদের তেলসম্পদ নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। আর বাংলাদেশের রপ্তানির বাজার, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বিনিয়োগের উৎসে মার্কিন প্রাধান্য সর্বজনবিদিত। এ ছাড়া আছে আমাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর পড়তে যাওয়া; আরও আছে প্রতিরক্ষা সহেযাগিতা। এগুলোকে অবহেলা করে বাংলাদেশ যদি কোনো পদক্ষেপ নেয় তাহলে অন্ধকার গুহায় ঢুকে যাবে। এ রকম পদক্ষেপের উদাহরণ হতে পারে বৈদেশিক লেনদেনের চলমান সংকট মেটাতে চীন থেকে স্বল্পমেয়াদে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ। এ ধরনের সাহায্য শ্রীলঙ্কা নিয়েও উদ্ধার পায়নি। এর কারণ সমস্যাটা কাঠামোগত, মৌসুমি নয়।
এবার রাজনীতি ও অর্থনীতির পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনায় আসি। এই মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার একটি অকার্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক করা কঠিন হবে। যেনতেন নির্বাচন করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও বেগবান করা কঠিন হবে। যারা বেনামি টাকা নিয়ে গেল; পুঁজিবাজার থেকে টাকা লুট করল; ব্যাংকিং খাতকে ফোকলা করে দিল এবং যারা ১০ টাকার প্রকল্প ব্যয়কে হাজার টাকা বানালো; তাদের ওপর জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে সমস্যা থেকেই যাবে। অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন প্রয়োজনীয় বৈধতা দেবে না– মানে মূল সমস্যা মিটবে না। আর সেরূপ বৈধতা না থাকলে এসব কায়েমি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে কার্যকর জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে না।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি