ডেস্ক রির্পোট:- যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাতে বড় বিপর্যয়ের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উপরে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকরা এখন দমকলকর্মী হয়ে নিজের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে এই আগুন থেকে রক্ষার রাস্তা খুঁজতে শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিন দিনের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে গেছে বড় দু’টি ব্যাংক। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমানতকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও ব্যাংকিং খাতের সংকট চাপা থাকছে না। এই সংকট এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিনিয়োগকারী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক রিপোর্টে জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বৃদ্ধির কৌশল হাতে নিয়েছিল। সেটিই এখন ব্যাংকিং খাতের ওপর পাল্টা আঘাত হেনেছে। চলমান এই অস্থিতিশীলতা থামাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন তাদের এই সুদের হার বৃদ্ধিতে লাগাম টানতে চাইছে। মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে গত কয়েক দশকের মধ্যে সব থেকে দ্রুত গতিতে সুদের হার বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশ। এর ফলে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই বাধাগ্রস্ত হয়নি, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বন্ডের দামও পড়ে গেছে। এর ফলেই যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংকের পতন হয়েছে।
এই পরিণতি ঠেকাতে এখন তৎপর হয়ে উঠেছে ইউরোপীয় দেশগুলো।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশঙ্কা, সুদের হার বৃদ্ধির কারণে মহাদেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ফলে সোমবার জার্মানির কেন্দ্রীয় বুন্দেস ব্যাংক তাদের ক্রাইসিস টিমকে ব্যাংক এবং বাজারের সম্ভাব্য পতন মূল্যায়ন করার নির্দেশ দিয়েছে। দেশটির কমার্স ব্যাংকের শেয়ারের দাম এরই মধ্যে ১৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এদিকে বৃটেনে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের স্থানীয় শাখা কিনে নিয়েছে এইচএসবিসি ব্যাংক।
এমন অস্থিতিশীল পরিবেশে ডলারের বিপরীতে দাম বাড়তে শুরু করেছে ইউরোর। গত সপ্তাহের তুলনায় ডলারের দাম ২ সেন্ট কমে গেছে। বর্তমানে এক ইউরো কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১.০৭৪ ডলার। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছে পরিস্থিতি সামাল দিতে ফেডারেল রিজার্ভ হয়তো দ্রুতই সুদের হার কমাতে শুরু করবে। আবার প্রশ্ন উঠছে, এই সংকট সমাধানে কি মার্কিন কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট করেছে নাকি এই সংকট এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে!
বিনিয়োগকারী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের এই সংকটের কারণে যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে সেটিই বিশ্বজুড়ে অন্য ব্যাংকগুলোকে সংকটে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আয়ারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সাবেক ডেপুটি গভর্নর বলেন, যখন আপনি এই পর্যায়ে সুদের হার বৃদ্ধি করবেন তখন কোথাও না কোথাও ভাঙন শুরু হবেই। তবে বিশ্লেষকরা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানিয়েছেন যে, এখন পর্যন্ত ২০০৮ সালের মতো বিশ্বব্যাপী মন্দা শুরু হওয়ার তেমন একটা আশঙ্কা নেই।
তারপরেও বিনিয়োগকারী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাবধান থাকছে। বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ফেড এ বছরের শেষ দিকে সুদের হার কমিয়ে আনবে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ফেড চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েল মার্কিন আইনপ্রণেতাদের বলেছিলেন যে, তাদের সুদের হার ধারণার থেকে বেশি বৃদ্ধি করতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কী অবস্থা
বিশ্বব্যাপী প্রভাব কেমন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও সংকটের জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তিন দিনের মধ্যে সেখানে দুটি জনপ্রিয় ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মাত্র একদিনে ১০,০০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যপতন হয়েছে দেশটির ব্যাংকগুলোতে। একে ‘ওয়াল স্ট্রিটে রক্তক্ষরণ’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। হোয়াইট হাউজের সাবেক একজন উপদেষ্টা এই পতনকে বরফখ-ের অগ্রভাগ বলে উল্লেখ করেছেন। তার আশঙ্কা, আসল অবস্থা হয়তো এর থেকেও বহুগুণ খারাপ।
মাত্র একদিনেই ওয়াল স্ট্রিটে আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোতে মূল্যপতন হয়েছে শতকরা ৬০ ভাগ। সোমবার সিটি গ্রুপের শেয়ারের মূল্য পড়ে গেছে শতকরা ৭.৪৫ ভাগ। ওয়েলস ফারগোর পতন হয়েছে শতকরা ৭.১ ভাগ, ব্যাংক অব আমেরিকার পতন হয়েছে শতকরা ৫.৮ ভাগ এবং জেপি মর্গানের পতন হয়েছে শতকরা ১.৮ ভাগ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক স্টাফ স্টিভ মুর এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, সিস্টেম সুস্থ আছে। তবে আমার মনে হচ্ছে প্রচুর প্রভাব পড়তে পারে ব্যাংক একই রকম সমস্যায় পড়তে পারে। ডেইলি মেইল জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক হলো ফার্স্ট রিপাবলিক। তাদের শেয়ারের পতন হয়েছে শতকরা ৬২ ভাগ। ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্স শতকরা ৪৭ শতাংশ দাম হারানোর পর লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। কি-কর্পের শেয়ারের পতন হয়েছে শতকরা ২১ ভাগ।
বাজারব্যবস্থা খোলার আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিনিদের আশ্বস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিরাপদ আছে। এ বিষয়ে আস্থা থাকতে হবে মার্কিনিদের। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কয়েক মিনিট আগেই ওয়াল স্ট্রিটে পতন শুরু হয়। এর আগে শুক্রবার আকস্মিক পতন হয় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহৎ ব্যাংক এসভিবির। বিনিয়োগকারীরা এ সময় পাগলের মতো তাদের তহবিল প্রত্যাহার করে নিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে ভয় ঢুকে যায় যে, ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আর সঠিক পথে রাখা সম্ভব হবে না।
স্টিভ মুর ফক্স নিউজকে বলেন, কীভাবে এই ব্যাংকিং সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা জনগণের বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনা ঘটেছে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি, কেন্দ্রীয় সরকারের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার কারণে। এমন অবস্থা আপনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে দিতে পারেন না। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে সুদের হার বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালজুড়ে বেশ কয়েকবার সুদের হার বৃদ্ধি করেছে ফেডারেল রিজার্ভ। এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে সেই ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা। কিন্তু এই পদক্ষেপ এসব বড় ব্যাংকগুলোকে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটে ফেলছে। মানবজমিন