ডেস্ক রির্পোট:- দেড় যুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ বৃহস্পতিবার দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল বুধবার মধ্যরাতে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সহধর্মিণী ডা. জোবাইদা রহমান ও মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান।
আজ সকালে সিলেটে যাত্রাবিরতির পর বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ঢাকায় অবতরণের কথা রয়েছে বাংলাদেশ বিমানের নিয়মিত ফ্লাইটটির। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অভ্যর্থনা জানাবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১২ সদস্য।
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে বড় প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। রাজনৈতিক অঙ্গন, দলের নেতাকর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ, কৌতূহল ও আবেগের সঞ্চার হয়েছে। দল ও সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে ৩০০ ফুটে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দেবেন তিনি। সেখানে তিনি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাবেন। এরপর চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে যাবেন। সেখান থেকে গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায় যাবেন তারেক রহমান। সেই বাসায় থাকবেন তিনি।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা মাহদী আমিন জানিয়েছেন, তারেক রহমানের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার ছিল দেশে নেমেই সরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়া। তবে ৩০০ ফুটে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। সেখান থেকে হাসপাতালে গিয়ে মায়ের পাশে থাকবেন। পরে সরাসরি গুলশানের বাসায় যাবেন।
বক্তা শুধু তারেক রহমান
বিএনপির সূত্র জানায়, মঞ্চে সকাল ৮টা থেকে কর্মসূচি শুরু হবে। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও থাকবে। দুপুর ১২টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন দলটির নেতাকর্মীরা। মূলত ওই সময়ে তারেক রহমান বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বিএনপির মহাসচিব।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ৩০০ ফুটের অনুষ্ঠানটি কোনো জনসভা নয়, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও নয়। শুধু দেশবাসীর প্রতি তাঁর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও দেশনেত্রীসহ দেশের সবার কল্যাণ কামনায় দোয়া অনুষ্ঠান। সেই আয়োজনে তারেক রহমান ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো বক্তা থাকছেন না। আমরা এই আয়োজন যত ছোট রাখতে চাই না কেন, ১৭ বছর ধরে অপেক্ষমাণ নেতাকর্মী-সমর্থকদের স্রোত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আমাদের নেই। তারপরও আমরা আমাদের সমর্থকদের নির্দেশনা দিয়েছি, তারা যেন কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন।
মঞ্চে যারা থাকবেন
তারেক রহমানের উপস্থিতিতে মঞ্চে দলের স্থায়ী কমিটির ১২ সদস্য ছাড়াও সমমনা দলের মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী, ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, এলডিপির সাবেক মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদসহ আট দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতাদেরও সংবধর্না অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা
তারেক রহমানের দেশে ফেরার ঘটনায় সবচেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে নিরাপত্তা ইস্যু। তাঁর জন্য সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি বিএনপির বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তারেক রহমান জাপান থেকে আনা বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ কার ব্যবহার করবেন। এই গাড়ির চারপাশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। পূর্বাচলে ৩০০ ফুট সড়কে যে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, তার চারপাশে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকবে।
বিমানবন্দর থেকে তারেক রহমান নিজ গাড়িতে করেই সংবর্ধনাস্থল, এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বাসভবন পর্যন্ত যাবেন। তাঁর নিরাপত্তায় চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সের (সিএসএফ) পরিধিও বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকেও স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরি করা হয়েছে।
তারেক রহমানের নিরাপত্তা দলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দলগত যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সেটি সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র একটা অংশ হলো সিএসএফ। সরকারের তরফ থেকে আমাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকার তার বিভিন্ন বাহিনী এবং সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।’
নেতাকর্মীর ঢল
নেতাকে একনজর দেখতে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মী-সমর্থক রাজধানীতে জড়ো হচ্ছেন। গত মঙ্গলবার হতে দূর-দূরান্ত থেকে কেউ নিজ উদ্যোগে, কেউ দলীয়ভাবে ঢাকায় আসেন। আশপাশের জেলা থেকে আজ সকালে নেতাকর্মীরা আসবেন। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, ৩০০ ফুটে মঞ্চের সামনে এবং এর আশপাশে হাজার হাজার নেতাকর্মী সকাল থেকেই অবস্থান নিয়েছেন। তাদের হাতে দলীয় পতাকা ও ফেস্টুন দেখা গেছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের আশপাশে নেতাকর্মীর ভিড়ও বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষকেও সেখানে দেখা যায়। ৩০০ ফুট থেকে মহাখালী পর্যন্ত সড়ক বিভাজকে ফেস্টুন ও ব্যানার টানানো হয়েছে। সড়কের পাশে, ফ্লাইওভার এবং ওভারব্রিজেও বড় বড় ব্যানার টানানো হয়েছে। টানানো হয়েছে বিলবোর্ডও। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ যাতে তারেক রহমানের বক্তব্য শুনতে পান, এ জন্য ৩০০ ফুট থেকে হোটেল র্যাডিসন পর্যন্ত মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের স্বাগত জানাতে সাতটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র করা হয়েছে। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে রং লাগানোসহ সাজসজ্জা করা হয়েছে।
জনদুর্ভোগ কমাতে উদ্যোগ
জনদুর্ভোগ কমাতে ঢাকাজুড়ে ২০টি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, প্যারামেডিক, ওষুধপথ্য ও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পগুলোর তালিকা জনসাধারণের সুবিধার্থে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ ফুটের কাছাকাছি ছয় শয্যার একটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার সঙ্গে আইসিইউ সুবিধাসম্পন্ন অ্যাম্বুলেন্স সংযুক্ত থাকবে। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ, সর্বত্র মোবাইল টয়লেট স্থাপন ও কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।
যানজট এড়াতে রাজধানীতে প্রবেশের প্রধান পয়েন্টগুলোতে আলাদা বাস পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিমানবন্দরগামী ও বিদেশফেরত যাত্রীদের পাশাপাশি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে কাকলী মোড়, বিমানবন্দরের সামনে এবং আবদুল্লাহপুরে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। এসব ডেস্ক থেকে মোটরবাইক এসকর্টের মাধ্যমে জরুরি যান চলাচল নির্বিঘ্ন রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে কাঞ্চন ব্রিজ ও ঢাকার প্রবেশমুখগুলো ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শুক্র ও শনিবারের কর্মসূচি
গতকাল দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কমিটির আহ্বায়ক সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, শুক্রবার বাদ জুমা শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত এবং সেখান থেকে সড়কপথে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন তারেক রহমান। পরদিন শনিবার তিনি নিজে ভোটার হবেন। এ ছাড়া সেদিন শাহবাগে শরিফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত এবং পঙ্গু হাসপাতালে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে যাবেন।
বসবেন চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে
দেশে ফিরে তারেক রহমান নিয়মিত বসবেন গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। সেই ভবনের দোতলায় একটি কক্ষ নতুনভাবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জন্য সাজানো হয়েছে। নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দোতলায় চেয়ারপারসনের কক্ষের পাশেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের ১০/সি বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বিএনপির অফিস হিসেবে। চারতলা এই ভবনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে দোতলায় রয়েছে ব্রিফিং রুম। অন্যান্য তলায় বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে গবেষণা সেল। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন বলেন, এটি বিএনপির একটি কার্যালয়। এখান থেকে নির্বাচনের সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
দেড় যুগের নির্বাসন জীবন
এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের প্রথম দিকে ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে যৌথ বাহিনী তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া হয় এক ডজনের বেশি মামলা। যৌথ বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে ভর্তি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। সেখানে থেকে উচ্চ আদালতে জামিনে মুক্ত হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে।
সে সময়ের সরকারের বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর নির্বাসন জীবন শুরু হয়। দেড় যুগের এই নির্বাসনে লন্ডন থেকে দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৩টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা হয়। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় তাঁকে। গণমাধ্যমেও তাঁর বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় আদালতের মাধ্যমে। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একে একে সব মামলা থেকে খালাস পান তারেক রহমান।সমকাল
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com