ডেস্ক রির্পোট:- গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজারের বেশি মানুষ। তাদের
মধ্যে শুধুমাত্র রায়েরবাজার কবরস্থানেই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে ১১৪ জনের লাশ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এসব শহীদদের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয়নি।
সরজমিন রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, কবরস্থানের বামপাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে ৪ নম্বর ব্লকের ৩৭ নম্বর লেনে সারিবদ্ধভাবে দাফন করা রয়েছে জুলাই আন্দোলনে নিহত ১১৪ জনের লাশ। দাফন করা এসব কবরের পুরো জায়গা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পাকা দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। দেয়ালের কালো টাইলসের ওপর নামফলকে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এর শহীদদের গণকবর’। এ ছাড়াও পুরো দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন সূরা লেখা হয়েছে। কবরগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ও গোরখোদকেরা বলেন, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের এই ৪ নম্বর ব্লকে সাধারণত বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে নাম-পরিচয়হীনভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশগুলো প্রশাসনের মাধ্যমে দাফন করা হতো। গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময়ও যাদের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয়নি তাদের এখানে দাফন করা হয়। অন্যান্য কবরে যেমন নামফলকে নাম-পরিচয় উল্লেখ থাকে কিন্তু এই কবরগুলোতে তা নেই। আন্দোলনের সময় একের পর এক লাশ এসেছে আর আমরা মাটি দিয়েছি। বছরখানেক তো খালি অবস্থাতেই ছিল এই কবরগুলো। সম্প্রতি উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পুরো জায়গায় পাকা দেয়াল করে দেয়া হয়েছে। তাই ডিএনএ প্রোফাইলের মাধ্যমে কারোর লাশ শনাক্ত করা গেলেও নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় কাকে ঠিক কোন জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, জুলাইয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন মর্গ থেকে নাম-পরিচয়হীন মোট ৮০টি লাশ পুলিশের মাধ্যমে দাফনের জন্য আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর আগস্টে আরও ৩৪টি লাশ হস্তান্তর করা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রায়েরবাজার কবরস্থানে লাশগুলো পর্যায়ক্রমে দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। সবশেষ গত ৭ই আগস্ট একজন নারীসহ ৬ জন জুলাইযোদ্ধার লাশ এক বছর ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রাখার পর হস্তান্তর করা হয় আঞ্জুমানের কাছে। তাদেরকেও বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে।
এদিকে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিতকরণের পর পরিবারের কাছে শহীদদের লাশ হস্তান্তরের জন্য আদালতে লাশ উত্তোলনের আবেদন করেন মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক মো. মাহিদুল ইসলাম। আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৪ই আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাাফিজুর রহমানের আদালত রায়েরবাজার কবরস্থান থেকে বেওয়ারিশভাবে দাফন করা ১১৪টি লাশ তোলার নির্দেশ দেন। তবে এখন পর্যন্ত একটি লাশও উত্তোলন বা শনাক্ত করা হয়নি।
জুলাই আন্দোলনে নিহত যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী সোহেল রানার মা রাশেদা বেগম বলেন, গত বছরের ১৮ই জুলাই আন্দোলনে গিয়ে নিখোঁজ হন তার ছেলে সোহেল রানা। অনেক খোঁজ করার পরও সোহেলের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি ভিডিও দেখে বুঝতে পারি- ওইটা সোহেলের লাশ। এর ৩৪ দিন পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহের নথির মধ্যে সোহেলের ছবি খুঁজে পাই। সেখান থেকে জানতে পারি রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে আমার সন্তানকে দাফন করা হয়েছে। এরপর থেকে অনেকবার রায়েরবাজার কবরস্থানে এসেছি কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি ঠিক কোনটা আমার ছেলের কবর। শহীদ সোহেল রানার ভাই মোহাম্মদ জুয়েল বলেন, আমার ভাই তো বেওয়ারিশ না। পুলিশ আমার ভাইকে হত্যা করেছে। লাশ গুম করতে বেওয়ারিশভাবে দাফন করেছে। অপরদিকে, গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শরীফ জেনারেল হাসপাতালের সামনের রাস্তায় গত ৫ই আগস্টে মোহাম্মদ হৃদয়ের (২০) পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। এরপর পুলিশ হৃদয়ের নিথর দেহ একটি গলির দিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। যার ভিডিও প্রকাশ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই থেকে হেমনগর ডিগ্রি কলেজের ওই শিক্ষার্থী হৃদয়ের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার পরিবার। হৃদয়ের বড় বোন মোছাম্মৎ জেসমিন বলেন, হৃদয় পড়াশোনার পাশাপাশি কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতো। তাকে পুলিশ নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তার লাশ পাইনি। কোথায় তাকে দাফন করা হয়েছে তাও জানি না। লাশ না পাওয়ায় শহীদের তালিকায় আমার ভাইয়ের জায়গাও হয়নি। কোনো অনুদানও পাইনি। নাসরিন আক্তার নামে এক জুলাইযোদ্ধা বলেন, আসলে জুলাই আন্দোলনের সময় বেওয়ারিশ হিসেবে ঠিক কতোজনের লাশ কবর দেয়া হয়েছে, এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। জুলাই আন্দোলন চরমে পৌঁছানোর পর মরদেহগুলো কোথায় যাচ্ছে, কোথায় দাফন করা হচ্ছে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় কে কীভাবে মারা গেছেন, সেসব তথ্য পুরোপুরি সংরক্ষণ করেনি হাসপাতাল, পুলিশ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ। মৃত ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ থেকে লাশ চিহ্নিত করার সুযোগ থাকলেও সেটি ঠিকভাবে করা হয়নি তখন। শুধুমাত্র অফিসিয়ালি আঞ্জুমানের মাধ্যমে যেগুলো লাশগুলোর দাফন কার হয়েছে সেগুলোরই কাছে খাতা-কলমে হিসাব আছে। তা ছাড়া আর কারোর হিসাব নেই। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় আঞ্জুমানকেও তো চাপে রাখা হয়েছিল। তারাও তো তখন সঠিক তথ্য দিতে পারেনি।
রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক মো. রাব্বানি বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় বেওয়ারিশভাবে আঞ্জুমানের মাধ্যমে যাদের আনা হয় তাদের সকলকেই ৪ নম্বর ব্লকে দাফন করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন বলেন, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আমাদের যেসকল শহীদ ভাইয়েরা শুয়ে আছেন তাদের শনাক্তে আমাদের প্রচেষ্টা চলছে। যারা আন্দোলনে গিয়ে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে তাদের শনাক্তে সামাজিক যোগাযোগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আবেদন জমাও পড়েছে। একইসঙ্গে লাশগুলোর ডিএনএ প্রোফাইল তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি দ্রুতই আমরা তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে পারবো।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com