ডেস্ক রির্পোট:- চব্বিশের এই দিনেই সূচনা হয়েছিল রক্তাক্ত এক বিপ্লবের। অপ্রতিরোধ্য তারুণ্যের প্রতিবাদী শক্তি উপড়ে ফেলেছিল চরম ফ্যাসিবাদী শাসনের মসনদ। প্রবল গণ-অভ্যুত্থানে স্বাধীন দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো শাসক বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের ঝড় এলোমেলো করে দেয় দেশের রাজনীতির মাঠ। ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাতের এই আন্দোলনে জীবন দিতে হয়েছে হাজারো মানুষকে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর বেপরোয়া বুলেটে আহত হন ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। আওয়ামী লীগের পোষ্য ক্যাডার বাহিনীর আক্রমণেও হতাহত হয়েছেন অনেকে। জুলাই-আগস্টের এই গণ- অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শহীদ ও আহতদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয়। আহতদের চিকিৎসা ও শহীদ পরিবারকে সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু গণ- অভ্যুত্থানের সূচনার এক বছর সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। হয়নি আহতদেরও সঠিক তালিকা। এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন অনেক জুলাই যোদ্ধা। তাদের কেউ কেউ আবার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়ারও অভিযোগ করে আসছেন।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে এখন পর্যন্ত তাদের তালিকায় আহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৩৯৩ জন। আর নিহত ৮৫৪ জন। কিন্তু এই হিসাবের বাইরে আরও হাজারখানেক আহত রয়েছেন। নিহতদের তালিকায়ও উঠে আসেনি সবার নাম। বেওয়ারিশ হিসাবে ঢাকার বিভিন্ন কবরস্থানে অনেক শহীদের মরদেহ দাফন করা হয়েছে। তাদের অনেকের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। পূর্ণাঙ্গ তালিকা কবে হবে তারও কোনো ঠিক নাই। ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, কিছুদিনের মধ্যে আরও কয়েকজন শহীদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ সহকারী বাবুল বলেন, জুলাই-আগস্টে নিহত ৬ জনের মরদেহ এখনো মর্গে পড়ে আছে। দীর্ঘদিন থেকে এই মরদেহগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা মো. মশিউর রহমান (যুগ্ম সচিব) বলেন, জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো প্রস্তুত করা হয়নি। আন্দোলনে শহীদদের তালিকায় কিছু নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। অতি সম্প্রতি একটি গেজেটের মাধ্যমে ১৫ থেকে ২০ জনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ছাড়াও আহতদের তালিকা চূড়ান্তকরণে কিছুটা সময় লাগবে। যেহেতু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস সার্ভারে নতুন করে নাম এন্ট্রি বন্ধ আছে, আবার অনেক আবেদন এমআইএস সার্ভারে পেন্ডিং অবস্থায় আছে। সবমিলিয়ে উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হবে যে নতুন করে আহতদের নাম নিবেন কিনা। জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের মাসিক ভাতা দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানে অনেক সংখ্যক লোকদের জন্য ভাতা দেয়ার সিস্টেম চালু হচ্ছে। সুতরাং আমাদের আরেকটু সময় নিতে হবে। জুলাই মাস থেকেই ভাতা দেয়া শুরু না হলেও, যাদের ভাতা দেয়া হবে তাদেরকে জুলাই থেকেই কাউন্ট করা হবে। তবে আগস্ট থেকে ভাতা দেয়া শুরু হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে ২ মাসের ভাতা অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের ভাতা একসঙ্গে দেয়া হবে।
ফাউন্ডেশন সূত্র জানিয়েছে, যাত্রার পর গত বছরের ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে ১১০ কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে আহত ও নিহতদের। আহতদের চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য বেসরকারি খাতে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে পুনর্বাসন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকৃত শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে এমআইএসভিত্তিক যাচাইকৃত তালিকা প্রস্তুত করা হবে। জাল দাবি বাতিলের জন্য অফিসিয়াল চিঠি দেয়া হবে। অজ্ঞাতনামা শহীদদের জন্য বিশেষ সেল গঠন। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হবে। এ ছাড়া প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শহীদদের নামে বৃক্ষরোপণ ও স্মৃতিফলক স্থাপন করা হবে। শহীদদের স্মরণে ৫ই আগস্ট বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। প্রান্তিক পর্যায়ের শহীদ পরিবারের চাহিদা তুলে ধরা হবে। জাতীয় পর্যায়ে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি ও সরকারকে সম্পৃক্ত করা হবে।
কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতন: ২০২৪ সালের ২রা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে সংগঠিত হয় এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনর্বহালের দাবিতে টিএসসি এলাকায় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। পরের কয়েকদিন দেশের অন্যান্য অংশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস ও এর আশপাশে মিছিল-সমাবেশ করে। ৪ঠা জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন ৬ই জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেয়। ৭ই জুলাই, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচির কারণে ঢাকা শহর স্থবির হয়ে যায়। এদিন ছয়টির বেশি ব্যস্ত সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ বিক্ষোভকে ‘অযৌক্তিক’ উল্লেখ করে বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
৮ই জুলাই অবরোধ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে। এতে করে ঢাকাবাসী ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভকারীরা একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে সব অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়ার একদফা দাবি জানান। ১০ই জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এই রায় সত্ত্বেও সরকার একটি ডেডিকেটেড কমিশন এবং পরবর্তী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি না দেয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ১১ই জুলাই হাইকোর্ট বলেন, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, কোটা পদ্ধতি সংস্কারে সংসদে আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সতর্কবার্তা দেয়, মন্ত্রীরা আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানালেও তা উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন। কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। ১২ই জুলাই ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে এবং কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়ে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। এদিন সাবেক আইনমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আন্দোলন চলতে থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। ১৩ই জুলাই রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
১৪ই জুলাই সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন আন্দোলনকারীরা। সেদিন সন্ধ্যায় একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বিতর্কিত মন্তব্য করেন, মন্তব্যে তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে উল্লেখ করেন। এই মন্তব্যের পর রাতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। ১৫ই জুলাই আওয়ামী লীগের নেতারা শিক্ষার্থীদের স্লোগানে ‘রাজাকার’ শব্দ ব্যবহারের নিন্দা জানান। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে আহত বিক্ষোভকারীদের ওপরও হামলা চালায়। সেদিন উভয়পক্ষের তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়।
১৬ই জুলাই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে অন্তত ৬ জন নিহত হন। সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের হল খালি করতে বলা হয়। সরকার ছয়টি জেলায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েন করে। সেদিন শিক্ষার্থীরা ঢাবি ও রাবি’র অধিকাংশ হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাঙচুর করে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিন নিহতদের ‘গায়েবানা জানাজা’ চলাকালে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা পরদিন থেকে সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে; হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেন। এদিন আন্দোলনকারীরা স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে যোগদানের আহ্বান জানান এবং সাধারণ নাগরিকদেরও সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকার আহ্বান জানানো হয়। এদিন শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বিক্ষোভকারীদের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানান এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন। অনুপ্রবেশকারীরা যাতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য তিনি শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। ১৮ই জুলাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ও ছাত্রলীগের লোকজন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ১৯টি জেলায় সংঘর্ষের ফলে সহিংসতায় কমপক্ষে ২৯ জন শহীদ হন। অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করা হয়। বিকাল থেকে সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিটিভি ভবন, সেতু ভবন ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোলপ্লাজায় সন্ধ্যায় আগুনের ঘটনা ঘটে।
১৯শে জুলাই দিনব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন কয়েকশ’ মানুষ। জুমার নামাজের পর সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষ তীব্র হয়। নরসিংদীর কারাগার, মেট্রোরেল স্টেশন, বিআরটিএ অফিসসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। যার মধ্যে ছিল শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে, কয়েকজন মন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদত্যাগ করতে হবে, হামলায় জড়িত ছাত্রলীগ ও পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দিতে হবে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। এদিন মধ্যরাত থেকে সরকার দেশব্যাপী কারফিউ ঘোষণা করে এবং সেনা মোতায়েন করে। ২০শে জুলাই কারফিউয়ের প্রথম দিনে অন্তত ২১ জন নিহত হন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ বাড়ানো হয় এবং দুইদিনের সাধারণ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিন গভীর রাতে সবুজবাগের একটি বাসা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে সাদা পোশাকে কয়েকজন জোর করে তুলে নিয়ে যায়। ২১শে জুলাই পূর্বাচলের একটি ওভারব্রিজের নিচে নাহিদ ইসলামকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাম উরু ও কাঁধে গুরুতর জখম, সারা শরীরে মারধরের চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এদিন সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
এদিন কারফিউয়ের মধ্যেও আন্দোলন চলাকালে গুলিতে অন্তত সাতজন মারা যান। ২২শে জুলাই পুলিশি অভিযানে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এক হাজার ৪২৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রায় ২০ হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন থানায় প্রায় ৫০টি মামলা দায়ের করা হয়। ষড়যন্ত্র ও সহিংসতার সন্দেহে বিএনপি ও জামায়াত জোটের কয়েকশ’ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩শে জুলাই সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে করার ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বিক্ষোভে নিহত ও আহতের বিচার দাবি করেন। এদিন কারফিউয়ের মধ্যেও বিরোধী নেতা ও বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার অভিযান চলমান ছিল। কিছু কিছু এলাকায় এদিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সচল হয়। তবে বন্ধ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
২৪শে জুলাই কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদকে পাঁচদিন পর পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা জানান, অজ্ঞাত কয়েকজন তাদের চোখ বেঁধে তুলে নিয়েছিল এবং বিক্ষোভ শেষ করার ঘোষণা দেয়ার জন্য নির্যাতন করেছিল। ২৫শে জুলাই সেনা মোতায়েনের পর শেখ হাসিনা প্রথম জনসমক্ষে আসেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন। তিনি অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর প্রতিরোধ করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। আহত-নিহতদের খোঁজ না নিয়ে মেট্রোরেল পরিদর্শন করায় আন্দোলনকারী ও সাধারণ জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এদিন জাতীয় পার্টির নেতা আন্দালিব রহমান পার্থ এবং ব্যবসায়ী ডেভিড হাসনাতসহ কয়েক ডজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তখনো বন্ধ ছিল। ২৬শে জুলাই পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়কে তুলে নেয়। এদিন জাতীয় ঐক্য ও সরকার পতনের আন্দোলনের অংশ নেয়ার আহ্বান জানায় বিএনপি। ২৭শে জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরতে এলাকায় এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা শুরু হয়। ডিবি আরও দুই সমন্বয়ককে তুলে নেয় এবং সমন্বয়কদের ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নেয়া হয়েছে বলে জানায়। ২৮শে জুলাই দেশব্যাপী পুলিশের অভিযান চলমান ছিল। শুধু ঢাকাতেই ২০০টিরও বেশি মামলায় ২ লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়। মোবাইল ইন্টারনেট সচল হলেও বন্ধ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন প্রধান হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে ছয় সমন্বয়কের এক টেবিলে বসে খাওয়ার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই একটি ভিডিও ও লিখিত বিবৃতিতে আন্দোলন শেষ করার ঘোষণা দেন ছয় সমন্বয়ক। তবে বাইরে থাকা অন্য সংগঠকরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। হেফাজতে থাকা ছয়জনকে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এদিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনে ১৪৭ জনের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে। ২৯শে জুলাই ছয় সমন্বয়কারীকে আটক ও হয়রানির প্রতিবাদে আবারো রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলের মুখে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এদিন সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। ৩০শে জুলাই কোটা আন্দোলন ঘিরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দেশব্যাপী শোক পালনের আহ্বান জানায় সরকার। এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা।
লাখো মানুষ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রোফাইলে লাল রংয়ের ছবি আপলোড করেন। ৩১শে জুলাই বিক্ষোভকারীরা ‘জাস্টিস ফর মার্চ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও লাঠিসোটা ব্যবহার করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। ঢাকা হাইকোর্ট চত্বরে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আইনজীবীদের একটি দল বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে অবস্থান কর্মসূচি করেন। সব শিক্ষার্থীদের পুলিশ হেফাজত ও কারাগার থেকে মুক্ত না করলে এইচএসসি পরীক্ষা বর্জন করা হবে বলে ঘোষণা দেন কয়েকশ’ পরীক্ষার্থী ১লা আগস্ট সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। জাতিসংঘ একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দল পাঠানোর প্রস্তাব দেয়, এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন ডিবি’র হেফাজত থেকে ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি দেয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা নিহতদের জন্য দোয়া-প্রার্থনা ও মিছিল কর্মসূচি করেন। ২রা আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে আরও দু’জন নিহত হন। বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও পুলিশি দমন-পীড়নের প্রতিবাদ অব্যাহত ছিল। সহিংসতায় নিহতদের বিচার চেয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত লাখো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, সুশীল সমাজের সদস্য ও রাজনৈতিক কর্মীরা ‘দ্রোহ যাত্রা’তে যোগ দেন। ৩রা আগস্ট ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষ সমবেত হন। দেশের অন্যান্য অংশে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলা করে পুলিশ। এদিন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৪ঠা আগস্ট সারা দেশে আওয়ামী লীগের সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষ হয়। দেশব্যাপী বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকসহ অন্তত ৯৩ জন নিহত হন।
এদিন মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা সারা দেশে নাগরিকদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ করার আহ্বান জানান। শুরুতে ৬ই জুলাই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানানো হলেও পরে তা একদিন আগে ৫ই আগস্ট করার ঘোষণা দেয়া হয়। ৫ই আগস্ট হাজারো মানুষ কারফিউ ভেঙে ঢাকার একাধিক মোড়ে জড়ো হয়ে রাজধানীতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। দুপুর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। প্রধানমন্ত্রী আরও বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তাকে জানানো হয় যে, এই ধরনের ব্যবস্থা অকার্যকর হবে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ছিল। পরে সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার ঘোষণা করেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পর পদত্যাগ করতে রাজি হন শেখ হাসিনা। দুপুরের পর তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এর পরই হাসিনার পতন উদ্যাপন করতে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ঢাকা শহর জনতার দখলে চলে যায়। সারা দেশে শুরু হয় বিজয় উৎসব। এদিন বিজয় উৎসব চলার মধ্যেও দেশের বিভিন্নস্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অনেকে শহীদ হন। মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com