অদিতি করিম:- পাঁচ দিন ধরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না। সেখানে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার রোগী আসে। প্রায় দুই শ অপারেশন হয়। নিরাপত্তাহীনতার কারণে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য কর্মকর্তারা কর্মস্থলে যাচ্ছেন না দেশের একমাত্র বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতালটিতে।
এ নিয়ে সরকার ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নেই। কারো যেন কোনো দায়িত্ব নেই।
দুই সপ্তাহ ধরে সচিবালয়ের অবস্থা প্রায় অচল। সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে সচিবালয়ের কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, তাদের ভাষায় ‘একটি কালো আইন’ বাতিলের দাবিতে।
সচিবালয়ে চলমান সংকট নিরসনে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। সরকারের উপদেষ্টাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়—চলুক না আরো কিছুদিন। দেখি না কী হয়।
গাজীপুরে জ্বালানি উপদেষ্টা গিয়েছিলেন।
কলকারখানার গ্যাসসংকট সরেজমিনে দেখার জন্য। দেশের বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা জ্বালানিসংকটে অচলপ্রায়। জ্বালানি উপদেষ্টার আশ্বাসের পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহবায়ক এবং সাবেক তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেড় শ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল।
সরকার নির্বিকার।
দেশে যেন একটা অরাজক অবস্থা চলছে। এসব দেখার জন্য কোথাও কেউ নেই। একটা দেশের সরকার আছে কি না, সেটিও এখন বোঝার উপায় নেই সাধারণ মানুষের। তারা বিপন্ন, অসহায়। তাদের যেন সিরাজউদ্দৌলার মতো এখন বলতে হচ্ছে, ‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কে দেবে আশা, কে দেবে ভরসা।’
প্রচণ্ড জনসমর্থন নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল গত বছরের আগস্ট মাসে। কিন্তু ১০ মাসে আমরা কী পেলাম? দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই যেন এই সরকার স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের সব অভ্যাস রপ্ত করছে। দেশে যে একটি বিপ্লব হয়েছে, নতুন বন্দোবস্ত কায়েম হয়েছে, বাস্তবে তা বোঝার উপায় নেই। আওয়ামী লীগ যেমন সব ব্যর্থতার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দায় এড়াত, এই সরকারও তাই করছে। ফ্যাসিস্ট সরকার যেমন সব কিছুর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ আবিষ্কার করত, এই সরকারও তাই করছে। শেখ হাসিনা যেমন কারণে-অকারণে বিদেশ যেতেন, ড. ইউনূসও সে পথেই হাঁটছেন। শেখ হাসিনা যেমন বিভিন্ন নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট নেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন, সেই রোগ যেন প্রধান উপদেষ্টার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব আবার ফিরে এসেছে আগের মতোই। সব দেখেশুনে মানুষের প্রশ্ন—‘শান্তি কোথায়’?
অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো প্রাপ্তি নেই। আমরা রাজনীতির কথাই ধরি না কেন। রাজনীতিতে যে ঐক্যের ফসল হিসেবে বাংলাদেশ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছিল, সেই ঐক্য আজ বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপ করেছেন। সংলাপ নিয়ে যেন এখন ‘কমেডি নাটক’ চলছে। সংলাপ সংলাপ খেলার প্রথম লিগ শেষ হয়েছে। এখন যেন দ্বিতীয় লিগ শুরু হলো। এই খেলা কবে শেষ হবে, জাতি জানে না। জাতীয় ঐকমত্য করতে এত দিন সময় যে লাগে না, সেটি বোধ করি অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরাও জানেন। এটি একটি কালক্ষেপণের কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অনিশ্চয়তা বাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই একটি রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি করে ‘ডিভাইড অ্যান্ড পলিসি রুল’ গ্রহণ করতে চাইছে বলেও অনেকে মনে করেন। এটি ক্ষমতায় টিকে থাকার বহুল প্রচলিত কৌশল।
এটা এখন স্পষ্ট, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকার যে শক্তি কেন্দ্রগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সমর্থন ছাড়া কি নির্বাচন না করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের শক্তিকেন্দ্রের একটি হলো রাজনৈতিক ঐক্য। সব রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। রাজনৈতিক দলের যদি ঐক্য না থাকে, একটি অংশ যদি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে তাদের ক্ষমতায় থাকা চ্যালেঞ্জিং হবে না?
এই সরকারের আরেকটি শক্তিকেন্দ্র সশস্ত্র বাহিনী। তারা মূলত দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। দেশ এখন যেটুকু ঠিক আছে, তা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই। সশস্ত্র বাহিনী কাল যদি ব্যারাকে ফিরে যায়, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী ভয়ংকর অবস্থা হবে, তা চিন্তাও করা যায় না। আমরা কজন বাড়িঘরে থাকতে পারব, তা আমরা জানি না। এই অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর কথাকে আমলে নেওয়া, সশস্ত্র বাহিনীকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের পথনির্দেশ চূড়ান্ত করাটা অন্তর্বর্তী সরকারের জরুরি কর্তব্য। কিন্তু সেই কাজটি তারা করছে না। কোনো কোনো মহল দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কথায় কথায় সশস্ত্র বাহিনীর সমালোচনা করছে। আশার কথা যে, সশস্ত্র বাহিনী এখন পর্যন্ত সীমাহীন ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এই ধৈর্য নজিরবিহীন। বিশেষ করে রংপুরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম যেভাবে শান্ত, ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে মব ঠেকিয়েছেন, তা সত্যি সত্যি স্যালুট জানানোর মতো ঘটনা। এই সময় জাতীয় নাগরিক পার্টির একজন নেতা যেভাবে একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন, তা শুধু অসৌজন্যমূলক নয়, এক ধরনের ধৃষ্টতাও বটে। ওই সেনা কর্মকর্তা বয়সে ওই ছাত্রনেতার পিতৃতুল্য। এ রকম একজন ব্যক্তির সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয়, সেই শিষ্টাচার যদি একজন ছাত্রনেতা না জানেন, তাহলে তিনি দেশের জনগণকে কী দেবেন? এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভিডিও ছড়িয়ে যাওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, জুলাই বিপ্লবের তথাকথিত বিপ্লবীদের শিষ্টাচার, ভদ্রতা এবং পারিবারিক শিক্ষা নিয়েও। সে প্রসঙ্গে আমরা যেতে চাই না। মূল বিষয় হলো দেশ আজ গভীর সংকটে। কোনো কিছুর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষ আর পারছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ—নির্বাচন। জনগণের অভিপ্রায়ের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন দেওয়াটা অন্তর্বর্তী সরকারের এখন প্রধান কাজ হওয়া উচিত। এটি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। কিন্তু নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের গাড়ি জুড়ে দিয়ে সংকট বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে সময়ক্ষেপণ কি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কৌশল?
নির্বাচন যত পেছাবে, তত রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়বে, তত দেশে নতুন করে সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সেটি নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। সশস্ত্র বাহিনী যদি সত্যি সত্যি ডিসেম্বরের পর ব্যারাকে ফিরে যায়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কী হবে, তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু ভেবেছে? নাকি চোখ বন্ধ করে আছে কোনো কিছু না দেখার জন্য?
দেশের রাজনীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনীতি। নতুন অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হলো। এই বাজেটে কোনো সম্ভাবনা নেই, কোনো নতুন আশাবাদ নেই। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের ভাষায়—কোনো রোডম্যাপ নেই। বাজেট করা হয়েছে আগের সরকারের চর্বিতচর্বণ। তাহলে আমরা কী পেলাম? যেসব সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, সেই সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিফলন এই বাজেটে সাধারণ মানুষ পাবে কিভাবে? কিভাবে পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নেই বাজেটে।
সরকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বিনিয়োগ সম্মেলন করেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনা হচ্ছে, তাঁরা কত টাকা বিনিয়োগ করবেন, সেই গল্প মানুষকে শোনানো হচ্ছে। এসব গল্প যেন এখন ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথার মতো। পড়তে খুবই উপাদেয়, কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আদর-অ্যাপায়ন করা হচ্ছে বটে, কিন্তু দেশীয় বিনিয়োগকারীদের কী অবস্থা? একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে যখন বিনিয়োগ করতে আসবেন, তখন তিনি দেশীয় একজন উদ্যোক্তার সঙ্গে প্রথম কথা বলবেন। তিনি জানতে চাইবেন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন, নিরাপত্তা কেমন, ব্যবসার পরিবেশ কেমন? কোনো ব্যবসায়ী কী এখন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, দেশে ব্যবসা সহায়ক পরিস্থিতি রয়েছে? কোনো ব্যবসায়ী কি বলবেন, তিনি ঠিকমতো বিদ্যুৎ-গ্যাস পাচ্ছেন? একজন ব্যবসায়ী কি আজ বলতে পারবেন, তিনি হয়রানির শিকার হচ্ছেন না? সরকার নানাভাবে তাঁর জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না?
এটা বলাই বাহুল্য, শিল্প-কারখানায় আগুন, ব্যবসায়ীদের হয়রানি ইত্যাদির ফলে অনেক ব্যবসায়ীই এখন রীতিমতো দেউলিয়া হয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনে তলবের মতো অসম্মানজনক ঘটনা। এ রকম একটি পরিবেশে আর যাই হোক, কোনো সত্যিকারের বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আসবেন না। এ জন্য দরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। অথচ সেদিকে সরকারের কোনো মনোযোগ নেই। যেভাবে বিনিয়োগ সম্মেলন করা হয়েছে, সেভাবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের আস্থায় নেওয়ার কথা সরকার ভাবছে না।
সমাজ জীবনে অস্থিরতা এখন একটা স্বাভাবিক চিত্র। প্রতিদিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। মব সন্ত্রাস এখন মব ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ আতঙ্ক। সরকার কোনো কাজ করছে না। সরকার শুধু তার নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে যেন ব্যস্ত। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দেশ কোথায় যাচ্ছে? সামনের দিনগুলোতে আমাদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে গোটা জাতি উদ্বিগ্ন। ১০ মাসের মাথায় পেছনে ফিরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে এই সরকার যেন জনগণের কথা ভাবছে না। জনগণের জন্য তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। বরং এই সরকারের নিজস্ব কিছু ইস্যু আছে, কিছু এজেন্ডা আছে। সেই এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নের জন্যই সরকার মরিয়া। এখন এটা স্পষ্ট হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার তার ওই এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন দেবে না। ক্ষমতাও ছাড়বে না। এ রকম পরিস্থিতিতে জনগণ কী করবে সেটাই হলো দেখার বিষয়। অনেকে মনে করছেন সরকার অন্ধ হয়ে আছে, এ জন্যই সারা দেশে যে এখন প্রলয় তাণ্ডব চলছে, তা সরকারের দৃষ্টিগোচরে আসছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হবে?
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : auditekarim@gmail.com
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com