ডেস্ক রির্পোট:- পার্বত্য চট্টগ্রাম—বাংলাদেশের এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো ভূস্বর্গ, যা আজ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও সহিংসতার এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হয়েছে। একদিকে সমৃদ্ধ বনভূমি ও অপার খনিজ সম্পদ, অন্যদিকে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ চক্রের অব্যাহত নিপীড়ন—এই দুই বিপরীত বাস্তবতা আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর লাগামহীন চাঁদাবাজি, নিপীড়ন, অপহরণ ও হত্যার মর্মন্তুদ চিত্র আজ পাহাড়ের মানুষের জন্য এক নিত্যনৈমিত্তিক বিভীষিকা। চাঁদার টাকায় পরিচালিত হয় সন্ত্রাসীদের অস্ত্র কেনা, নাশকতা ও সামরিক প্রশিক্ষণ, যা এক ভয়ংকর বৃত্ত তৈরি করেছে—যেখানে নিরপরাধ জনগণ নিঃশেষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এই প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির ভয়াবহতা, এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহায়ত্বের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হবে। যখন উন্নয়নের নামে বৈষম্যের অগ্নিকুণ্ড দাউদাউ করে জ্বলছে, তখন চাঁদাবাজির এই অভিশাপ পার্বত্য জনপদকে ক্রমশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ৬টি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠন চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে, এবং এই চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা চাঁদা করছে তারা। এসব সন্ত্রাসী সংগঠন, যেমন ইউপিডিএফ, জেএসএস, কেএনএফ, দল-উপদল চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ, ধনী, গরীব, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবিরাও। চাঁদাবাজি বর্তমানে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ক্ষমতা এবং তাদের অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
এই চাঁদাবাজির মাধ্যমে সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। চাঁদা না দিলে অপহরণ, খুন, গুমের মতো ঘটনা ঘটছে, এবং চাঁদাবাজির এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণ এক ভয়াবহ সংকটে রয়েছে। এমনকি সরকারি উন্নয়ন কাজ, যেমন সড়ক, ব্রিজ নির্মাণও থমকে যাচ্ছে, কারণ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো চাঁদার দাবিতে অবাধে হস্তক্ষেপ করছে।
১. পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠনগুলোর বিগত বছরগুলোর চাঁদাবাজি, যা কিছু ঘটনাও এই চাঁদাবাজির ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদার দাবিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, লাখো মানুষ বিপাকে:
পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) মোবাইল টাওয়ার অপারেটরদের কাছে চাঁদা দাবি করে। অপারেটররা অস্বীকৃতি জানালে চলতি বছরের গত ২২ জানুয়ারি ভোরে সন্ত্রাসীরা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির ১১টি মোবাইল টাওয়ারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে দীঘিনালা, মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গা ও নানিয়ারচরসহ বিভিন্ন এলাকায় লাখো মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেড় মাসে ইউপিডিএফ অনন্ত ৭ বার হামলা করে। এতে ৫০টি টাওয়ারের নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। পূর্বে রবি কোম্পানি বাৎসরিক ইউপিডিএফ কে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা প্রদান করতো। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইউপিডিএফ এই চাঁদা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। জানা গেছে বর্তমানে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করছে। এই অর্থ চাঁদা পরিশোধ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক সক্রিয় করতে ইচ্ছুক নয় রবি কোম্পানি।
এতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ইউপিডিএফ হুমকি দিয়েছে, চাঁদা না দিলে অন্যান্য এলাকাতেও একই কৌশল অবলম্বন করবে। মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে গত ১৯ এপ্রিল মানিকছড়িতে দুপুরে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার মেরামতে গেলে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ - প্রসীত) সন্ত্রাসীরা রবি কোম্পানির দুই টেকনিশিয়ানকে অপহরণ করেছে। অপহৃত ব্যক্তিরা হলেন মো. ইসমাইল হোসেন (৩৫) এবং আব্রে মারমা (২৫)। স্থানীয় জনগণ আতঙ্কে থাকলেও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নেওয়া হয়নি।
সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, নইলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।
২. গত ২৪ এপ্রিল এক সূত্রের তথ্য মতে জানা গেছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় রাঙ্গামাটিতে ২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ৭টি ভবনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে ঘটনার সত্যতা জানা গেছে।
এর আগে রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়কে ব্রিজ নির্মাণে জেএসএসের হামলা, চাঁদার দাবিতে কাজ বন্ধ হয়েছিল।
রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়কের ৪১ কিলোমিটার এলাকায় সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ব্রিজ নির্মাণ ও মাটি কাটার কাজ চলছিল। কয়েক মাস ধরে জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে দুপুরে, জেএসএসের ১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী কাজের স্থলে এসে সাব-কন্ট্রাক্টর সৈয়দ (৩৬)-কে মারধর করে। তারা বন্দুকের নল দিয়ে আঘাত করে এবং জুতা ও পা দিয়ে চেপে ধরে নির্যাতন চালায়। হামলার ফলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ৫০-৬০টি গাড়ি আটকা পড়ে। সৈয়দকে তাইংখালী নিয়ে যাওয়ার পথে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির খবর পেয়ে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
এলাকাবাসী সৈয়দকে উদ্ধার করতে গেলে জেএসএস তাদের ওপরও হামলা চালায়। গুরুতর আহত সৈয়দকে প্রথমে বান্দরবান জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামে রেফার্ড করা হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়, যেখানে ব্রিজের ৭৫% এবং মাটি কাটার ২০% কাজ শেষ হয়েছে। বিশাল অঙ্কের চাঁদার কারণে উন্নয়ন কাজ থমকে গেছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, চাঁদা পরিশোধ করলে প্রকল্পের গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জেএসএসের আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড স্পষ্ট করেছে যে, চাঁদা না দিলে কাজ চালিয়ে যেতে দেওয়া হবে না।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়ংকর কাঠ পাচার ও চাঁদাবাজির রাজত্ব—
পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ কাঠ পাচারকে কেন্দ্র করে ভয়ংকর চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএস কাঠের প্রতিটি বর্গফুট থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছে। কাঠবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে ২০,০০০ টাকা এবং জ্বালানি কাঠের গাড়ি থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়।
সন্ত্রাসীদের 'টোকেন' ছাড়া কাঠ বের করা নিষিদ্ধ! কাঠ ব্যবসায়ীরা চাঁদা পরিশোধের জন্য আঞ্চলিক দলগুলোর কাছ থেকে বিশেষ টোকেন সংগ্রহ করতে বাধ্য হন। এটি মাসিক, বাৎসরিক বা এককালীন ভিত্তিতে সংগ্রহ করা হয়। কোনো ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি, অপহরণ বা গুলি করে হত্যা করা হয়।
কাঠ পাচারের রুট:
১. বান্দরবান:
লামা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর
২. রাঙ্গামাটি:
রাঙ্গামাটি মানিকছড়ি, কাউখালী, কাপ্তাই, নানিয়ারচর ও রাঙ্গামাটি সদর
৩. খাগড়াছড়ি:
মানিকছড়ি, মাটিরাঙা, দিঘীনালা, রামগড় ও খাগড়াছড়ি সদর।
চাঁদাবাজির গডফাদাররা:
ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ)
জেএসএস (সন্তু গ্রুপ)
কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট)
দলীয় উপদল।
এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পাতি নেতারা।
আঞ্চলিক দলগুলোর আয়ের ৮০% কাঠ পাচার থেকে আসে, যা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার মূল অর্থের যোগান দেয়। চাঁদার টাকা অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, অপহরণ ও হত্যার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতায় এই রক্তচোষা চাঁদাবাজ চক্রকে পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ভয়ংকর সন্ত্রাসী কাঠ পাচার চক্র অবিলম্বে রুখতে না পারলে, পরিবেশের পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়বে।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির ক্ষতিকর প্রভাব কৃষকদের উপরও পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২২ জুন ২০২৪ তারিখে ইউপিডিএফের সদস্যরা খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার পাকলাপাড়া এলাকায় মিশ্র ফলজ বাগান ধ্বংস করে, যার ফলে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
৫. একইভাবে, ২০১৪ সালে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়িতে চাঁদার দাবিতে ইউপিডিএফের হামলায় বাঙালি কৃষকদের প্রায় ১২ একর আনারস বাগান এবং ২০ হাজার সেগুন গাছ ধ্বংস করা হয়, যার মূল্য ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা।
৬. স্বজাতি নারীকে চাঁদার হুমকি: ৫ মার্চ ২০২৪ তারিখ ইউপিডিএফ দ্বারা এক উপজাতি তরুণীকে চাঁদার জন্য হুমকি দেওয়া হয়, পরে তার সন্তান অপহরণ করা হয়। তার বাড়ি খাগড়াছড়ি দীঘিনালা তিনি চট্টগ্রাম পোষাক শ্রমিক হিসেবে কর্মরত।
৭. কাউখালী কলমপতি মাঝেরপাড়া সরকারি প্রাথমিক স্কুল নির্মাণের চাঁদাবাজি: গত ৫ মার্চ ২০২৪ তারিখে ইউপিডিএফ কলমপতি ইউনিয়নের মাঝেরপাড়া স্কুল নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়, চাঁদার দাবিতে শ্রমিকদের অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি প্রদান করেন।
৮. পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা স্থানীয় জনগণ ও ঠিকাদারকে ভয় দেখিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করছে, মোটা অংকের চাঁদাও আদায় করছে এবং মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে। এতে পাহাড়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
এছাড়াও সরকারি টেন্ডারের বাজেটের ৫% থেকে ১০% চাঁদা ঠিকাদার থেকে আঞ্চলিক দল আদায় করে।
০৯. বাঙালি দালালদের ভূমিকা: জমি ক্রয়-বিক্রয়ে আগাম তথ্য সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছানো হয়। আঞ্চলিক দলগুলোর প্রলোভনে পড়ে সন্ত্রাসীদের হয়ে বাঙালি এলাকার চাঁদা কালেকশন করে দেন।
১০. কথিত আছে গত ১৬ এপ্রিল ৫ শিক্ষার্থী অপহরণ করার পর মুক্তিপণ হিসেবে ইউপিডিএফ ১২ লাখ টাকা আদায় করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি কেন্দ্রিক অপহরণ এবং বিগত বছরের কয়েকটি আলোচিত ঘটনা:
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির ঘটনা কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো—
১. গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি গিরিফুল থেকে ইউপিডিএফ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ শিক্ষার্থী অপহরণ।
২. বান্দরবানের রেইছা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্মাণাধীন কাজের কেয়ারটেকার বাবুলকে অপহরণ ঘটনা।
৩. বান্দরবানে রাবারবাগান শ্রমিক অপহরণ:
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালীর দুর্গম মুরুংঝিরি এলাকা থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মুক্তিপণের জন্য ২৬ জন রাবারবাগান শ্রমিককে অপহরণ করে। অপহরণকারীরা মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করেছে বলে জানা গেছে।
এর আগে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে একই এলাকায় আরও ১০ জনের বেশি শ্রমিক অপহৃত হন। স্থানীয় সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে শ্রমিকদের অপহরণ করেছে, যার ফলে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অপহৃতদের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় জানা গেছে। নতুন করে অপহরণের জন্য গত ২৬ এপ্রিল চাঁদা দাবি করা হয়েছে।
৪. কেএনএফ কর্তৃক সোনালী ব্যাংক রুমা শাখার ম্যানেজার অপহরণ:
২ এপ্রিল ২০২৪: বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কেএনএফ সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখায় ডাকাতির চেষ্টা চালায়। ভল্ট খুলতে ব্যর্থ হয়ে তারা ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে।
৪ এপ্রিল: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তাকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে, নিরাপত্তার স্বার্থে নেজাম উদ্দিনকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শাখায় বদলি করা হয় এবং রুমা শাখায় সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নারায়ণ দাশকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
৫. রাঙ্গামাটিতে নির্মাণ শ্রমিক অপহরণ
২ মার্চ ২০২৪: রাঙামাটি শহরের কলেজ গেট এলাকা থেকে টিটু নামে এক নির্মাণ শ্রমিককে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের রেস্ট হাউস নির্মাণকাজে কর্মরত ছিলেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ঠিকাদার মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, তবে এখনো অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। রাঙ্গামাটি কোতোয়ালি থানার ওসি জানিয়েছেন, তারা ঘটনাটি জানেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৬. প্রতিপক্ষ কর্তৃক ইউপিডিএফ নেতা অপহরণ:
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) অভিযোগ করেছে যে, তাদের সমর্থিত প্রার্থী প্রণতি রঞ্জন খীসার নির্বাচনী কমিটির সমন্বয়ক প্রীতিময় চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছে।
তবে নানিয়ারচর থানার ওসি আব্দুল লতিফ জানিয়েছেন, থানায় এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। ইউপিডিএফ মনে করছে, এটি তাদের দোষী প্রমাণ করার জন্য পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হতে পারে।
৭. মুক্তিপণ আদায়ে নানিয়ারচরে ২৭ জন অপহরণ:
৮ জুলাই ২০১৮: রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের হাতিমারা এলাকায় ২৭ জনকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় সূত্র জানায়, কাঁচামাল বহনকারী নৌকা থামিয়ে অস্ত্রধারীরা তাদের অপহরণ করে।
ইউপিডিএফ (মূল) এই ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ (বর্মা গ্রুপ) ও জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপকে দায়ী করেছে। সংগঠনটির মুখপাত্র জানিয়েছেন, সশস্ত্র সদস্যদের নেতৃত্বে অপহরণটি ঘটানো হয়েছে। ইউপিডিএফ ঘটনার প্রতিবাদে ৯ জুলাই মানববন্ধনের ঘোষণা দেয়। তবে নানিয়ারচর থানার ওসি জানান, তিনি এ বিষয়ে কোনো রিপোর্ট পাননি।
জানা গেছে পরবর্তীতে মোটা অংকের মুক্তিপণ নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৮. বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ আদায়ের জন্য সরকারি টেলিটক কর্মী অপহরণ:
১৪ জুলাই ২০১৩: রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মারিশ্যা এলাকায় টেলিটকের পাঁচ কর্মী অপহরণ করা হয়। পুলিশ তিনজন সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করেছে, যারা পার্বত্য চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রথমে অপহরণকারীরা ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলেও পরে এটি তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পাঁচ দিন পরও অপহৃতদের অবস্থান জানা যায়নি। সেনাবাহিনী ও পুলিশ উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে।
অপহৃতদের মধ্যে টেলিটকের প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন, টেকনিশিয়ান মো. হেমায়েত হোসেন, সুপারভাইজার সুজাউদ্দিনসহ আরও কয়েকজন রয়েছেন।
পরবর্তীতে বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ দিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়।
৯. পানছড়িতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী অপহরণ:
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার তালতলা এলাকা থেকে আল ফালাহ ট্রেডিং কর্পোরেশনের ঠিকাদারের সহকারী সাইফুদ্দিন শাহিন গাজী (৩৫) ও ম্যানেজার মো. রুহুল আমিন (৫০) অপহৃত হন।
অপহরণকারীরা প্রথমে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে, যা পরে ৩০ লাখ টাকায় নামানো হয়। পরিবার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মধ্যস্থতার চেষ্টা চালায়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, এ অপহরণের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) যুক্ত থাকতে পারে। তবে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. মজিদ আলী জানিয়েছেন, কোনো অভিযোগ না আসায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে অপহরণের ঘটনা বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে এসব অপহরণ সংঘটিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী অপহৃতদের উদ্ধারে অভিযান চালালেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এসব ঘটনায় পাহাড়ের মানুষ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছে। চাঁদাবাজি রোধে স্থানীয়দের প্রতিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে—
গত ১১ জানুয়ারি ২০২৫ সালে রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার গাড়িছড়া এলাকায় স্থানীয় জনগণ ইউপিডিএফের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চা দোকানি মো. ওসমানের কাছে চাঁদা দাবি করলে তিনি অস্বীকৃতি জানান, ফলে ইউপিডিএফ সদস্যরা তাকে ও ইউপি সদস্য মো. ইসলামকে অপহরণের চেষ্টা করে। খবর ছড়িয়ে পড়লে দুই শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা সংঘবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দেয়, তারা পালিয়ে গেলেও একটি সিএনজি আটক করা হয়।
এরপর স্থানীয়রা ৩১ সদস্যের প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে, যার লক্ষ্য ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রতিহত করা। সম্প্রতি সংগঠনটি চাঁদাবাজি বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে বাঙালি এলাকাগুলোতে। স্থানীয়দের এই প্রতিরোধ চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে সচেতনতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও জনগণের নিরাপত্তা আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
চাঁদার জন্য হত্যা:
২০১৯ সালের ৯ জুন, খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বড়ইতলী গ্রামে ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় আবদুর রহিম বাদশা (২৫) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে। রাতে বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায় জানালা দিয়ে মাথায় গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ইউপিডিএফ দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি করছিল, আর রহিম বাধা দেওয়ায় তাকে টার্গেট করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসের ভয়াবহ পরিস্থিতি আজ এক অগণনীয় মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে। এই অঞ্চলটি, যা এক সময় ছিল স্বর্গীয় শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক, এখন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অব্যাহত অত্যাচার, অপহরণ, হত্যাযজ্ঞ এবং অবৈধ কার্যক্রমে পার্বত্য জনগণের জীবন এক অনবরত আতঙ্কের মাঝে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজি শুধু যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, তা নয়, বরং এটি পুরো অঞ্চলের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, এই চাঁদাবাজির মাধ্যমে মানবিক অধিকারগুলোও একদম চুরমার হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম—সবই থমকে গেছে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চাঁদার দাবির কারণে। মোবাইল টাওয়ারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, আর তাই স্থানীয় জনগণ একে একে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলোকে চাঁদাবাজির আগুনে ভস্মীভূত হতে হচ্ছে, আর কাঠ পাচারের মতো অবৈধ কার্যক্রম আজ এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কার্যক্রমের দুর্বলতা কেবল এক গভীর অন্ধকারে পতনের সূচনা। যদি এই চক্রটির বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, বরং পুরো দেশের শান্তি, সার্বভৌমত্ব এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হবে। অবিলম্বে সরকারের কার্যকরী হস্তক্ষেপ এবং তীব্র আইনি ব্যবস্থাপনা না হলে, চাঁদাবাজির এই বিপথগামী অশুভ প্রভাব আরও বিস্তৃত হয়ে পুরো দেশকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্দিনে ঠেলে দিতে পারে। সংগ্রীত
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com