ডেস্ক রির্পোট:- সীমান্তে দিনের পর দিন মানুষ হত্যা করেই চলেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এর মধ্যেই সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তে নানা ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে বাহিনীটি। বিএসএফের বাড়াবাড়ির কারণে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশেষ করে সীমান্তের শূন্যরেখায় ভারতীয় বাহিনীর কাঁটাতারের বেড়া দেওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা আরও বাড়ছে। তবে ভারতের সীমান্ত আগ্রাসন রুখে দিতে তৎপর বাংলাদেশ। এরই মধ্যে কুড়িগ্রামে বিজিবির কড়া প্রতিবাদের মুখে সীমান্তের শূন্যরেখায় লাগানো সিসি ক্যামেরা সরিয়ে নিয়েছে বিএসএফ।
সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সাংবাদিকদের দেওয়া বক্তব্যে সেটিই স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘রক্ত ঝরলেও সীমান্ত সুরক্ষিত থাকবে।’
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬১৭ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। এ সময়ে তাদের হামলায় আহত হন অন্তত ১ হাজার ১০০ জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের বিতর্কিত শ্যুট অন সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি এবং ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের কার্যত ভারত নিয়ন্ত্রিত পররাষ্ট্রনীতির কারণে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করে আসছে ভারতীয় বাহিনী। আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ তিন মেয়াদসহ গত ১৬ বছরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী খাতুনের লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকার সেই ছবি বিশ্বব্যাপী ভারতীয় বাহিনীর বর্বরতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হলেও নির্বিকার ছিল তৎকালীন হাসিনা সরকার। উল্টো সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ নিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলাদেশিদের দায়ী করে বক্তব্য দিতেন।
সামরিক বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম বলেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধে পাল্টা গুলিই একমাত্র সমাধান। সাম্প্রতিক সীমান্ত উসকানিসহ সার্বিক বিষয়ে বিএসএফকে বার্তা দিতে হবে, ‘এনাফ ইজ এনাফ’। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে, আজ নয় এখনই। নইলে একটি গুলির বদলে তিনটি গুলি চলবে’। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত থেকে পরিকল্পিতভাবে বিএসএফ সদস্যদের বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োজিত করা হয়।
বিজিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারতীয়দের গুলি করা কিংবা সীমান্ত উত্তেজনা বাড়ানোর উদ্দেশ্য নয়: বরং বিএসএফের হত্যাকাণ্ড থামাতে হলে সীমান্তে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে গুলির বদলে পাল্টা গুলির বিষয়টি ঘোষণা দেওয়া উচিত।
এদিকে শেখ হাসিনার শাসনামলে শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকেনি বিএসএফ, বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নাগরিকদের নির্যাতন করত। অনেক সময় অপহরণ করে নিয়ে নির্যাতন চালাত।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে ভারতীয়রা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তিন বাংলাদেশিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলেও এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে খুব বেশি এগোতে দেয়নি হাসিনা সরকার।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ বলেছে, সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের ধর্ষণ ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। জানা গেছে, বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী সাধারণত বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিকদের সাহায্য করে না। বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিজিবি ছিল কার্যত অসহায়।
বিজিবি সূত্র বলছে, ভারতীয় বাহিনীর তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করছে না দেশটি। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পর বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালকপর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে আগামী ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি।
বিজিবির উপমহাপরিচালক (মিডিয়া) কর্নেল শরীফুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা দেবে বাংলাদেশ।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. উমর ফারুক বলেন, সীমান্ত হত্যা, সাম্প্রতিক সময়ে বিএসএফের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আন্তর্জাতিক অংশে বিএসএফ পাঁচ যুগ ধরে যে বাড়াবাড়ি করে চলেছে, তার পুরো দায় দিল্লির। পতিত হাসিনার পলায়নের পর সম্প্রতি বিএসএফ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চাইছে। কারণ, হাসিনার আমলে বাংলাদেশ যে স্বাধীন রাষ্ট্র, ভারত সেটা ভুলেই গিয়েছিল। তিনি বলেন, ভারতীয় কোনো নাগরিক অবৈধভাবে ঢুকলে তাকে তো বিজিবি গুলি করে না, গ্রেপ্তার করে আইনের কাছে সোপর্দ করে, তাহলে বিএসএফ কেন হাজার হাজার বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে। বিএসএফের ‘দেখা মাত্র গুলি করার’ যে নীতি অনুসরণ করা হয়, তা বাতিল করতে হবে।
বিএসএফের সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞ
গত ৭ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রঘুনাথপুর সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি কৃষক বারিকুল ইসলামকে হত্যা করে বিএসএফ। গত জানুয়ারিতেই মাত্র আট দিনের ব্যবধানে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। জানা গেছে, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ফেনীর পরশুরামে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ মেরামতে বাধা দেয় বিএসএফ। বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থানের কারণে জনমনে আতঙ্ক আর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিজিবি প্রতিবাদ করলে পিছু হটে ভারতীয় বাহিনী।
গত বর্ষায় পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নের নিজকালিকাপুর সীমান্তের শূন্যরেখায় বল্লামুখার বাঁধ কেটে দেয় বিএসএফ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৩০ জানুয়ারি ভারতের ঈশান চন্দ্র নগর ও বাংলাদেশের নিজকালিকাপুর ক্যাম্পের বিজিবি-বিএসএফেরর মধ্যে বিষয়টি সমাধানের জন্য পতাকা বৈঠক হয়।
গত ৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফ অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে গেলে বিজিবি বাধা দেয়। পরে ৮ জানুয়ারি বেড়া নির্মাণ সাময়িকভাবে বন্ধ করে তারা। ১০ জানুয়ারি শিবগঞ্জের চৌকা সীমান্তে বিএসএফ আবারও কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে গেলে উত্তেজনা শুরু হয়। সীমান্তের বাংলাদেশ-ভারত দুই দিকেই গ্রামের মানুষজন জড়ো হয় সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে। ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তখন। ১১ জানুয়ারি আবারও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ সীমান্তে দিনভর সংঘর্ষ হয়।
১০ জানুয়ারি রাতে শিবগঞ্জ উপজেলার আজমতপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আহত হন এক বাংলাদেশি। একই দিন সিলেটের বিয়ানীবাজারের গজুকাটা সীমান্ত এলাকায় ২০০ বছরের পুরোনো মসজিদ পুনর্নির্মাণে বাধা দেয় বিএসএফ। ৬ জানুয়ারি নওগাঁর ধামইরহাট সীমান্তেও বিএসএফ বেড়া নির্মাণ করতে গেলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একই দিন ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় কোদলা নদীর সীমান্ত এলাকায় বিজিবির কাজে বাধা দেয় ভারতীয় বিএসএফ।
গত জানুয়ারির শুরুর দিকে কুড়িগ্রাম ও নওগাঁ সীমান্তে পাঁচটি পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া তৈরির চেষ্টা করে বিএসএফ। ৬ জানুয়ারির পর থেকে বিজিবি বাধা দিলেও বেড়া নির্মাণকাজ চালিয়ে যায় বিএসএফ। পরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ওই দুই সীমান্ত পয়েন্টে। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সীমান্তে ১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই বিএসএফ ভারতের স্থানীয় কিছু জনতাকে নিয়ে নোম্যানসল্যান্ডের কাছে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করে। এ নিয়ে বিজিবির সঙ্গে স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকরা বাধা দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত বেড়া নির্মাণ বন্ধ করে বিএসএফ। গত বছরের আগস্টেও একই ঘটনা ঘটে দহগ্রামে। ওই ঘটনায় অন্তত পাঁচজন আহত হন।
১৫ জানুয়ারি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম সীমান্ত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার বেশ কয়েকটি জায়গায় কাচের বোতল ঝুলিয়ে রাখে বিএসএফ। স্থানীয় বাসিন্দারা এ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।আমারদেশ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com