রাঙ্গামাটি:- পার্বত্য চট্টগ্রামের উচ্চ শিক্ষা সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবিপ্রবি) এখনও চলছে ফ্যাসিবাদের রাম-রাজত্ব। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পদত্যাগ করেন (রাবিপ্রবি) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার এবং উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা।
তবে ভিসি ও প্রো-ভিসি দুজন পদত্যাগ করলেও প্রায় ছয় মাস জিম্মি হয়ে ছিলো প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক সকল কর্মকান্ড। এমনকি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ডিভাইস ও অফিসিয়াল যোগাযোগ মাধ্যম ই-মেইল আইডি এবং পাসওয়ার্ড কুক্ষিগত করে রাখেন পদত্যাগকারীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটে।
সর্বশেষ অনেক প্রচেষ্টা ও দেন-দরবারের মাধ্যমে গত ২৯ জানুয়ারি তাদের কাছে থাকা সরকারী ডিভাইসসহ ইমেইল আইডি ও পাসওয়ার্ড ফেরৎ পায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ভিসি, প্রো-ভিসি দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের পরও প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র, সরকারি ডিভাইস, ই-মেইল আইডি ও পাসওয়ার্ড কব্জায় রাখার কারণ জানতে সম্প্রতি অনুসন্ধান চালানো হয়। আর এ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে বেড়িয়ে আসে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিল ভাউচারের সমন্বয় আনতে ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় ফ্রিজ কেনার স্লিপ দেখানো হলেও বাস্তবে ফ্রিজের কোনো অস্থিত্ব নাই। সম্প্রতি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট্যদের নজরেও আসে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রাঙ্গামাটির রাবিপ্রবিতে প্রথম পর্যায়ে নিয়োগ পান ১২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি। এদের মধ্যে প্রায় ১২০ জনেরও অধিক রয়েছে একটি নির্দিষ্ট্য সম্প্রদায়ের লোক। তাদের মধ্যেই আবার রয়েছে একই গ্রামেরই অন্তত ৫০জন।
এছাড়াও রাবিপ্রবিতে স্বৈরাচারি সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতির লঙ্গণ করে চাকুরী পেয়েছেন। রিজেন্ট বোর্ডকেও এই ব্যাপারে কিছুই উপস্থাপন করা হয়নি বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব বিষয়ে সম্প্রতি দূর্নীতি দমন কমিশনেও লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-শিক্ষকরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-রেজিস্ট্রার প্রশাসন কামরুল হাসান। তার পিতা-মোহাম্মদ আলী পার্বত্য খাগড়াছড়ির স্বৈরাচারি দল আওয়ামী লীগের নেতা এবং রাঙ্গামাটির রাবিপ্রবি’র প্রথম ভিসি প্রদানেন্দুর ঘনিষ্টজন।
প্রদানেন্দুর সাথে আতাঁত করে অনৈতিক সুবিধায় কোনো রকম পরীক্ষা পদ্ধতির অনুসরন ছাড়াই রাবিপ্রবিতে নিয়োগ পান কামরুল। অদক্ষ হয়েও ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় প্রমোশন নিয়ে উপ-রেজিস্ট্রার হয়ে যান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম সক্রিয় সদস্য হওয়ায় কামরুলকে বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির। রাবিপ্রবি’র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় রাঙ্গামাটি সদরের একটি চিহ্নিত ফুলের দোকান থেকে নির্ধারিত বাজার মূল্যের কয়েকগুন বেশি মূল্যে ফুল ক্রয়ের ভাইচার করতেন তিনি। এভাবে বিভিন্ন দিবসে ফুল ক্রয়ের আড়ালে অন্তত ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে জানা গেছে। তাছাড়া রিজেন্ট বোর্ডের নামে বছরে বিনা টেন্ডারে লাখ লাখ টাকার জিনিসপত্র ক্রয় করতেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট্যদের অভিযোগ, বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকারের ভিসি সেলিনার সকল অপকর্মের বৈধতা দিতেন কামরুল হাসান। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও বিধি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের সাথে প্রেম ও প্রণয়ে জড়ান তিনি। সবশেষে একজনকে বিয়ে করতে হয়েছে তার।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমা। অযোগ্য হওয়া সত্বেও নিজের পছন্দের ও আতœীয়দের নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বানিয়েছেন মগ পাহাড়ের আরেক মগের মুল্লুক। প্রদানেন্দুর খুবই ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত অনিল জীবন চাকমা নামের একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ন অনৈতিকভাবে।
ইতিপূর্বে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে একটি প্রকল্পে প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে চাকুরী করতেন। পূর্বে সরকারি চাকুরীর অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও রাবিপ্রবিতে প্রকল্প সমন্নয়ক পদে চাকুরী পান তিনি। এই অনিলের বিরুদ্ধে উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ আত্নসাতের কারনে অডিট আপত্তি হয়, যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত চিঠিও আসে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু হতে নিয়োগ দপ্তরের প্রধান হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। যা সম্পূর্ন নিয়ম বর্হিভূত বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা। তাছাড়া অনিলের বিরুদ্ধে রাবিপ্রবি অফিসার্স এসোসিয়েশন এবং শিক্ষক সমিতি ও কর্মচারী সমিতি একাধিক বার লিখিত অভিযোগ দেয়।
একটি পদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তিন বার নিয়োগ (চুক্তিভিত্তিক) বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রকাশ করা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রে হয়েছে তার পুরোটাই ব্যাতিক্রম।
স্বামী রুহুল আমিনের বন্ধু হওয়ায় কোনো ধরণের নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মাঠ এটেন্ডেন্টকে সরাসরি রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. সেলিনা আক্তার। চাকুরী জীবনে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ করেন তিনি।
তাছাড়া রাসকিন চাকমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ লক্ষ টাকা অডিট খরচ (ঘুষ) হিসেবে খরচ দেখান। এই নিয়ে পরে তদন্ত কমিটি হয়। তবে এই ব্যায়কে রেজিস্ট্রার ইউসুফ অবৈধভাবে নামমাত্র তদন্ত দেখিয়ে তা বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন।
ইউছুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ভর্তি বানিজ্যের। পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করে দুরন্ত প্রতাপে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করারও অভিযোগ রয়েছে ইউছুপের বিরুদ্ধে।
পরীক্ষার নকল ও নিম্নমানের খাতা উচ্চ দরে ক্রয় করার অভিযোগও রয়েছে। একইভাবে মালামাল ক্রয় করা হত নির্দিষ্ট ভেন্ডার হতে। সাবেক ভিসি সেলিনাসহ যোগসাজশে করতেন ইউছুপ। আর এই ইউছুপের আপন শালাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে স্টোরের স্টাফ হিসেবে।
সর্বশেষ নিয়োগে ফ্যাসিস্ট সরকারের ক্যাডারদেরও চাকরি দেওয়া হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্ত্রাসী রকিব হোসাইন, শাহেদ সরোয়ার, গোলাম মোস্তফা সুমনদেরকে চাকরি প্রদান করা হয়। ইউছুপের আপন সমন্দি আশরাফ অফিস সহায়ক পিএস নিপেনের আপন ভাতিজা পারসন চাকমা অফিস সহায়ক আইটি সেকশন। ডেপুটি রেজিষ্টার মহিম আল মহিউদ্দিনের আপন চাচা সোহেল অফিস সহায়ক। গ্রীন লাইন পরিবহনের এর এজেন্ট। আউটসোর্সিং এ ৫ জনকে চাকুরি দিছে। তাদের বিষয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
একটি গ্রাম থেকে ৫০ জনেরও অধিক লোককে রাবিপ্রবিতে নিয়োগ ও প্রশাসনিক অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে জানতে রাবিপ্রবির সদ্য সাবেক (পদত্যাগকারী) ভিসি অধ্যাপক ড. সেলিনা আখতার এর মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল দিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর হোয়াটস্আ্যাপে কল ও টেক্স পাঠিয়ে সাড়া মিলেনি।
রাবিপ্রবি উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। আমরা জানি শুরুটা অত সহজ থাকে না। তার পরও সেই থেকে এখন পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বৎসর অত্রিকম করেছে। এই সময়ে এসেও এত অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা এটা ভাবা যায় না। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় এটাকে আর বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে। তিনি আরও বলেন, এখানকার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে এই নয় যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি বলে কোনো একটি গোষ্ঠিকে এককভাবে স্থান (পূর্ণবাসন) করে দিতে হবে!খোলা কাগজ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com