ডেস্ক রির্পোট:- রক্ত নিয়ে চলছে জমজমাট বাণিজ্য। এ বাণিজ্যে জড়িত একাধিক চক্র। যারা রোগীর জীবন-মৃত্যুকে নিয়ে খেলা করে। রোগীর অসহায় স্বজনদের জিম্মি করে ভেজাল রক্ত গছিয়ে দেয়। বিনিময়ে হাতিয়ে নেয় অতিরিক্ত টাকা। দুর্ঘটনায় আহত, ক্যান্সার, সন্তান প্রসব, থ্যালাসেমিয়া বা অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসায় রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এক ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে স্বজনদের পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। কেউ কেউ স্বজনদের কাছে রক্ত পেলেও অনেককেই আশ্রয় নিতে হয় হাসপাতাল কিংবা ব্লাড ব্যাংকের উপর। দেশের নামিদামি ব্ল্যাডব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে কঠোর থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় গজিয়ে ওঠা ব্লাডব্যাংক নেয় অনিয়মের আশ্রয়। তারা কখনো এক ব্যাগ রক্তের সঙ্গে স্যালাইন মিশিয়ে তিন ব্যাগ করে বিক্রি করে। আবার তাদের নিয়মিত রক্তদাতারা বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। আবার বহুদিনের পুরনো রক্তও অহরহ বিক্রি করছে তাজা বলে। এ অবস্থায় রক্ত এখন যেন এক বিষের নাম। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রক্তের সঙ্গে প্রতারণা করে যদি দূষণযুক্ত কোনো কিছু মেশায় তাহলে সেটি রোগীর শরীরে বিপরীত প্রতিক্রিয়া, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। এতে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। রোগী আক্রান্ত হতে পারে মরণঘাতী রোগে। যারা মাদকাসক্ত তাদের একটি বড় অংশ ইনজেকশনের সাহায্য মাদক গ্রহণ করে। একটি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ অনেকে ব্যবহার করে। তাই স্বজনদের উচিত নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহ করা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে বছরে আট থেকে নয় লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকলেও রক্ত সংগ্রহ হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ। সংগ্রহকৃত রক্তের মাত্র ৩০ শাতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। রক্তদাতাকে থাকতে হবে ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত। তিন মাস পর পর একজন দাতা রক্ত দিতে পারবেন।
শনিবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক এক ব্যাগ রক্ত চুরির সময় ধরা পড়ে নাঈম খান ও আবদুল্লাহ নামের দুই কিশোর। তাদের পুলিশ হেফাজতে নিলে মিলে ভিন্ন তথ্য। পুলিশ জানায়, তারা একটি চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে রক্ত চুরি করেন। প্রতি ব্যাগ রক্তে স্যালাইনের সঙ্গে মিশিয়ে তিন ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করেন। এ ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের থেকে তারা রক্ত সংগ্রহ করে বিক্রি করে, সরকার অনুমোদিত ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত না নিয়ে তারা ভুয়া ব্লাড ব্যাংকের কথা বলে এসব রক্ত বিক্রি করেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ব্লাড ট্রান্সমিশনের সংজ্ঞা মতে, নিরাপদ রক্তের জন্য একজন রক্তদাতাকে কমপক্ষে পাঁচটি রক্তবাহিত ঘাতক রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হয়। সেগুলো হলো- হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি বা এইড্স, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিস।
সূত্রমতে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অলি-গলিতে গড়ে উঠেছে লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ব্লাড ব্যাংক। সেখানে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে রক্ত। কিন্তু এ রক্ত দূষিত কিনা তা বের করার উপায় নেই। অনেকে দূষিত রক্তের ভয়ে নির্ভরশীল হচ্ছেন পরিচিতজনদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহে। সম্প্রতি পটুয়াখালী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ৫৫ বছর বয়সী জাহানারা বেগম। পড়ে গিয়ে তার কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন। অপারেশনের জন্য তার প্রয়োজন ছিল দুই ব্যাগ রক্তের। এই রোগীর স্বজন বলেন, দশদিন হাসপাতালে ভর্তির পর অপারেশন করা লাগবে বলে চিকিৎসক জানান। তার অপারেশনের জন্য দুই ব্যাগ বি-নেগেটিভ ব্লাড সংগ্রহে রাখতে বলেন। প্রথমে আমরা কোথাও ব্লাড খুঁজে পাইনি। পরে সন্ধানীতে গিয়ে এক ব্যাগ ব্লাড পাই সেটি ৪ হাজার ৫০০ টাকায় ক্রয় করি। প্রথম ব্যাগ দিয়ে অপারেশন শুরু হয়। পরবর্তীতে আরেক ব্যাগ ব্লাড খুঁজতে থাকি সেটি গুগলে সার্চ দিয়ে পান্থপথের একটি বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকের সন্ধান পেয়ে ৪ হাজার ৯০০ টাকায় ক্রয় করি। ক্রয়ের পর ওই ব্লাড ব্যাংকেই রেখে আসি যখন প্রয়োজন হবে তখন গিয়ে নিয়ে আসবো ভেবে। পরে এক ব্যাগেই আমাদের অপারেশন হয়ে যায়। পুরো টাকা দিয়েই তাদের কাছ থেকে ক্রয় করেছি। তিনিও ওই ব্যাগ রক্ত আরেক রোগীর কাছ থেকে ক্রয় করেন। পরবর্তীতে দরকার হবে না বলে জানিয়ে টাকা ফেরত দিবে কিনা জানাই। পরে তারা ৪ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে মাত্র ১ হাজার টাকা ফেরত দেয়। রক্তের ব্যাগও তাদের কাছে ছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ব্লাড বিভাগে এসেছেন শফিক। গত ৭ই জানুয়ারি তার বন্ধু জাহিদ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত ৪ ব্যাগ এবি পজিটিভ রক্ত লেগেছে। আরেক বন্ধু রক্ত দিবে। হাসপাতালের রক্তের উপর বিশ্বাস নেই। অনেক সময় হাসপাতালে পুরনো রক্ত থাকে আর তাছাড়া হাসপাতালের রক্তের মান নিয়ে তাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তাই নিজেরাই বন্ধুদের থেকে রক্ত সংগ্রহ করছেন। কুমিল্লা থেকে ঢামেকে এসেছেন রহিমা। তার ১১ বছরের নাতি নাজিমের কিডনিতে সমস্যা। এক ব্যাগ রক্ত লাগবে তার। রহিমা বলেন, ব্লাড ব্যাংকে এসেছি ডোনারকে সঙ্গে নিয়ে। নাতির ও পজিটিভ রক্ত লাগবে ডোনার আমাদের আত্মীয়। অটোচালক রাব্বি গত ১৬ই জানুয়ারি তার ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। ছেলের খাদ্যনালীতে সমস্যা ডাক্তার বলেছেন অপারেশন লাগবে। ১ ব্যাগ বি-পজিটিভ রক্ত প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, রক্ত যদি হাসপাতাল থেকে নিই তাহলে ২০০০-২৫০০ টাকা নিতো। চাচাতো ভাই রক্ত দিবে তাই মনে শান্তি আছে। হাসপাতালের পুরনো রক্ত কেন দেবো আর তাছাড়া এইখানে অনেক নেশাগ্রস্ত লোক এসে রক্ত বিক্রি করে সেজন্য হাসপাতালের রক্তের উপর বিশ্বাস নেই।
আলিফ ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা ক্যামেপইন করে ডোনারদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করি। পজিটিভ গ্রুপের ব্লাড যেমন বি-পজিটিভ, এবি পজিটিভ ও পজিটিভ রক্ত ২৫০০-৩০০০ হাজার টাকা, আর নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাড এ-নেগেটিভ, বি-নেগেটিভ, এবি-নেগেটিভ এবং ও-নেগেটিভ ব্লাড পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করি। যদি রোগীরা ডোনার ম্যানেজ করে দেন সেইক্ষেত্রে ক্রস ম্যাচিং এবং অন্যান্য টেস্ট ফি বাবত ১৫০০ টাকা নিয়ে থাকি। নেগেটিভ রক্তগুলো সহজে পাওয়া যায় না সেইগুলো ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে ডোনারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের ডোনারদের যাতায়াত খরচ এবং খাওয়া বাবত আমাদের ৩৮০০-৪০০০ টাকা খরচ হয়। আমরা সীমিত লাভে প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো যেন খরচ যোগাড় হয় সেই পরিমাণ টাকায় রক্ত বিক্রি করে থাকি। সেইক্ষেত্রে আমরা নেগেটিভ রক্তগুলো পাঁচহাজার টাকায় বিক্রি করি। তিনি বলেন, যদি রোগী আমাদের থেকে দুই ব্যাগ রক্ত কেনেন কিন্তু এক ব্যাগ রক্ত ব্যবহার করা না লাগে সেইক্ষেত্রে আমরা রক্ত ফেরত নিই। পুরো টাকা ফেরত দেই না। ক্রস ম্যাচিং এবং অন্যান্য টেস্ট বাবদ আমাদের একটা অংশ খরচ হয়। এ টাকাটা রেখে দেই। এ ছাড়া আমরা এক্সচেঞ্জ করে রক্ত সংগ্রহ করি। মাদক সেবনকারীদের রক্ত বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এইসকল ঘটনা আগে হতো এখন আর এইগুলো হয় না।
দি ডায়াগনসিস ব্লাড ব্যাংকের বেলাল বলেন, আমরা এক্সচেঞ্জ করে ব্লাড সংগ্রহ করি। এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে এক ব্যাগ রক্ত নেই তাছাড়া ক্যামেপইন করে ডোনারদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করি। রোগীদের কাছ থেকে রক্তের গ্রুপ ম্যাচিং এবং অন্যান্য ফি বাবত ১৭০০-২০০০ টাকা নেই। ডোনারদের যাতায়াত এবং খাওয়ানোর পেছনে আমাদের একটা অংশ ব্যয় হয়। আমরা সেই টাকা শুধু রোগীদের কাছ থেকে নেই। অতিরিক্ত অর্থ নেই না। পজিটিভ গ্রুপের ব্লাডগুলো সহজে পাওয়া যায় আর নেগেটিভ গ্রুপের ব্লাডগুলো সংগ্রহ করতে আমাদের ডোনারদের পেছনে কিছু টাকা খরচ করতে হয়। আমরা যে গ্রুপের ব্লাড সহজে পাওয়া যায় সেই গ্রুপের ব্লাড ২৫০০ টাকা করে নেই। আর যেই গ্রুপের ব্লাড সহজে পাওয়া যায় না সেই রক্তগুলো ৪০০০ টাকায় বিক্রি করি। যেহেতু ডোনারদের ভাড়া করে আনতে হয়। সমস্ত প্রটোকল মেনটেইন করে ব্লাড সংগ্রহ করি। কোনো মাদকসেবীর কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করি না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তানজিন আরা করিম বলেন, আমরা ব্লাডের জন্য কারও কাছ থেকে টাকা নেই না, শুধু ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্য সরকার থেকে নির্ধারিত ফি নেয়া হয়। অনেক সময় দালালরা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেয়। কয়েকদিন আগেও আমরা এমন দালালকে ধরেছি। অনেক সময় কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে রোগীদের স্বজন ওয়ার্ডে থাকা অবস্থাতেই দালালরা রক্তের জন্য তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। রক্তের চাহিদা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রতিদিন ২০০-২৫০ ব্যাগ ও বছরে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার ব্যাগ রক্ত লাগে। আমরা সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহ করি। তাছাড়া অধিকাংশ সময় রোগীরা তাদের আত্মীয়-স্বজন থেকে ব্লাড সংগ্রহ করেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, রক্তদাতার শরীরে হেপাটাইটিস-বি অথবা হেপাটাইটিস-সি রয়েছে কিনা সেটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে। মূলত এই জাতীয় রোগগুলো রক্ত দ্বারা একজনের শরীর থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রক্তের সঙ্গে অন্যকিছু মেশানো অপরাধ। প্রতারণা করে যদি দূষণযুক্ত কোনো কিছু মিশিয়ে ফেলে তাহলে সেটি রোগীর শরীরে সাইড ইফেক্টসহ নানা জটিলতা বেড়ে যাবে। মারাত্মক বিপদসহ বিপর্যয় ঘটাবে। তিনি বলেন, যে রক্ত দিয়ে একজন মানুষকে সুস্থ করা দরকার সেই দূষিত রক্ত দেয়ার কারণে রক্ত গ্রহীতা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। রক্ত দান কেন্দ্র যেখানে-সেখানে হওয়া সমীচীন নয়। সরকারি নীতি বজায় রেখে এবং প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাপন রয়েছে সেগুলো ফুলফিল করে কেবলমাত্র ব্লাড ব্যাংক সেন্টার স্থাপন করা উচিত। তা না মানলে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। রক্ত সংগ্রহের পর প্রথমত, এটি ২৪ ঘণ্টা খুব ভালো পর্যায়ে থাকে এবং পরবর্তীতে ৪৮ ঘণ্টাও ব্যবহার করা যায়। এই সময়ের পর আর সেটি ব্যবহারযোগ্য থাকে না। ক্রস ম্যাচিংটা সবচেয়ে জরুরি। নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত ব্লাড ব্যাংক থেকে রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহ করা উচিত স্বজনদের। রক্তের দামও কিন্তু সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। বেশি দামে বিক্রি করলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com