ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) রোকন উদ্দিন, পি এস সি:- ‘আদিবাসী’ এবং ‘উপজাতি’ শব্দ দুটি প্রায়ই পরস্পর প্রতিস্থাপনযোগ্য মনে করা হয়। তবে এটি সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং আইনি প্রেক্ষাপটে ভিন্ন অর্থ বহন করে। এই পার্থক্যগুলো সমাজের সাংস্কৃতিক গতিশীলতা এবং সম্প্রদায়গুলোর আইনি অধিকার বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে, বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে উপজাতি জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে এবং তারা নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই প্রবন্ধে আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সম্প্রদায়ের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আদিবাসী বনাম উপজাতি জনগোষ্ঠী
আদিবাসী জনগোষ্ঠী : আদিবাসীরা একটি অঞ্চলের মূল বাসিন্দা, যারা ঔপনিবেশিকতা বা রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে সেই অঞ্চলে যুগ-যুগান্তরে ঐতিহাসিকভাবে বসবাস করতেন। তাদের সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পূর্বপুরুষদের ভূমি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের নেটিভ আমেরিকান এবং অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিনাল।
উপজাতি জনগোষ্ঠী : উপজাতি গোষ্ঠীগুলো সাধারণত দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে এবং তাদের অনন্য সামাজিক কাঠামো, ভাষা ও ঐতিহ্য বজায় রাখে। যদিও সব উপজাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয় না, তবে তাদের প্রান্তিকতার কারণে একই ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অঞ্চল হতে একটি স্থানে বসবাস শুরু করে।
আইনি স্বীকৃতি
আদিবাসীরা প্রায়ই আন্তর্জাতিক কাঠামোর আওতায় স্বীকৃতি পায়, যেমন জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণা (UNDRIP), যা তাদের অধিকার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে নির্দেশনা প্রদান করে। উপজাতি জনগোষ্ঠী কখনো কখনো জাতীয় সংবিধান বা নির্দিষ্ট আইনি বিধানের আওতায় স্বীকৃতি পায়, তবে এটি দেশে দেশে ভিন্ন হয়ে থাকে।
ওভারল্যাপ এবং পার্থক্য
যদিও সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের অনন্য সামাজিক কাঠামোর কারণে উপজাতি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, কিন্তু সমস্ত উপজাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কিছু উপজাতি গোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর আগমনের পরে একটি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে।
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায়
১। জাতিগত বৈচিত্র্য : পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ১১টি উপজাতি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, যার মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো এবং অন্যান্য গোষ্ঠী রয়েছে। প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুশীলন রয়েছে, যা অঞ্চলের বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের একটি বিশেষ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী, যারা ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে তাদের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থান নিয়ে কিছু বিতর্ক ও ভুল ধারণা রয়েছে। এই প্রবন্ধে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, তাদের মূল পরিচয় এবং বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
উপজাতি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং স্থানান্তর
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার, চীন এবং থাইল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সময়ে এসে বর্তমান দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তাদের আগমন কেবল স্থানান্তরের কারণ নয়, বরং সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া এবং অঞ্চলের বহুজাতিক পরিচিতির একটি অংশ। এটি তাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে বিতর্ক উত্থাপন করে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, তারা এই এলাকার আদিবাসী নয়, বরং পরবর্তীতে বসতি স্থাপনকারী। তাদের প্রধান জীবিকা ছিল জুম চাষ, যা পাহাড়ি অঞ্চলের একটি প্রচলিত কৃষিপদ্ধতি এবং এটি তাদের জীবনের কেন্দ্রীয় উপাদান ছিল।
আন্তর্জাতিক প্রচারণা এবং আদিবাসী দাবির উত্থান
২০০৭-২০০৮ সালের ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, চাকমা রাজা দেবাশিস রায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হওয়ার সুযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি বিশেষ প্রচারণা শুরু করেন। তার প্রচারণায় চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। জানা যায়, এই প্রচারণার পেছনে আন্তর্জাতিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্য ছিল। এর পর থেকে উপজাতি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সুবিধা ও সমর্থন পাওয়ার জন্য নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করতে থাকে। এই প্রচারণা শুধু আন্তর্জাতিক স্তরেই নয়, বরং স্থানীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। তাদের দাবিগুলোর ভিত্তিতে তারা বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের সমর্থন লাভ করেছে।
সরকারি সুবিধা এবং উন্নয়ন
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায় সরকারি কোটা সুবিধার মাধ্যমে শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ পেয়েছে। এই সুবিধাগুলোর মাধ্যমে তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতায় সহায়ক হয়েছে। তারা বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তবে এই উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে উত্তেজনা এবং ভূমি অধিকার নিয়ে সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিদের অভিযোগ, এই সুবিধাগুলো প্রায়ই পক্ষপাতমূলক এবং অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা ব্যাহত করে।
ঐতিহাসিক এবং প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল একটি বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হতো, যা এর অধিবাসীদের একটি বিশেষ মর্যাদা প্রদান করত। ব্রিটিশ প্রশাসন পাহাড়ি অঞ্চলের সম্পদ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মান্য করত। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর এই বিশেষ মর্যাদা হ্রাস পায় এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য উপজাতি সম্প্রদায়ের আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল শান্তিচুক্তি কিছু সমস্যার সমাধান আনলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো সম্পন্ন হয়নি। শান্তি চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জনগণের ঐতিহ্য, সম্পদ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা করা। তবে, এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ
উপজাতি সম্প্রদায়গুলো তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। আধুনিকায়নের ফলে তাদের ঐতিহ্যগত জীবনধারা হুমকির মুখে পড়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহ্যগত ভাষা এবং প্রথার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে, যা তাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি।
রাজনৈতিক প্রান্তিকতা
১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল শান্তিচুক্তি উপজাতি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ সমাধানে ভূমিকা রাখলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো অসম্পূর্ণ। প্রতিনিধিত্ব ও স্বায়ত্তশাসনের বিষয়গুলো এখনো একটি চ্যালেঞ্জ।
সামাজিক-অর্থনৈতিক সংগ্রাম
অনেক উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামোতে প্রবেশাধিকার অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে, যা দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের চক্রকে স্থায়ী করে।
বর্তমান অবস্থা ও প্রচেষ্টা
আইনি কাঠামো : সিএইচটি শান্তিচুক্তি এবং চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিষ্ঠা উপজাতি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে প্রয়োগে ফাঁক এবং পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের অভাব অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
এনজিও এবং সরকারি উদ্যোগ : বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারি প্রোগ্রাম উপজাতি সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবিকা উন্নয়নে কাজ করছে। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নথিভুক্ত ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টাও চলছে।
অ্যাডভোকেসি এবং সচেতনতা : উপজাতি নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা তাদের অধিকার স্বীকৃতি এবং আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণ এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
উপসংহার
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং তাদের পরিচয় নিয়ে বিতর্ক এবং চ্যালেঞ্জ দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান। যদিও তারা সরকারি ও আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে উন্নতি লাভ করেছে, তবে ভূমি অধিকার, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে। সরকার, স্থানীয় জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পাশাপাশি স্থানীয় বাঙালি এবং উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থানের একটি টেকসই মডেল তৈরি করা সময়ের দাবি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চল হতে বিভিন্ন সময়ে এসে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে বসবাস করে আসছে। তারা এই এলাকার আদিবাসী নয়। জানা যায়, ১/১১ এর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ পাওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশিস রায় তাদের নিজস্ব বর্ণনা অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে ভুল প্রচারণা চালান। এবং তার পর হতেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সুবিধা লাভের আশায় নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করতে থাকেন। সরকারি কোটা সুবিধা লাভ করে তারা বিভিন্নভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করে। তাদের জীবনধারা মূলত জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। ব্রিটিশ শাসনামলে সিএইচটি একটি বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হতো, যা এর অধিবাসীদের বিশেষ মর্যাদা দিত। তবে স্বাধীনতার পর এই স্বায়ত্তশাসন হ্রাস পায়, যা উত্তেজনার কারণ হয়।
আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য যথাযথ নীতিমালা ও আইনি কাঠামো তৈরিতে অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায় জাতির ঐতিহ্যের একটি সমৃদ্ধ কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, সিভিল সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডারদের একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে তাদের অধিকার সম্মানিত হয়, তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষিত হয় এবং তাদের উন্নয়ন চাহিদা পূরণ হয়। টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার মাধ্যমে সিএইচটির সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। সূত্র: ঠিকানা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com