ডেস্ক রির্পোট:- গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রের উত্থান ঘটে। রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দি পরা বা উর্দি ছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ী– এই তিন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে চোরতন্ত্র সৃষ্টি হয়। চোরতন্ত্রের বিষবৃক্ষ সৃষ্টির উৎস ছিল ২০১৪ সাল থেকে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জবাবদিহির জায়গা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এখান থেকে বেরোনোর জন্য জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। গতকাল অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশের পরদিন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এর প্রণয়ন কমিটির প্রধান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এমন মন্তব্য করেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনইসি ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শ্বেতপত্র কমিটির বাকি ১১ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। গত রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। কমিটি বর্তমান সরকারের ন্যূনতম দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সংলাপসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।
শুরুতে শ্বেতপত্র প্রণয়নের পদ্ধতি বর্ণনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল চুরির বর্ণনা দেওয়া। চোর ধরা কমিটির উদ্দেশ্য নয়। এটি দুদক, বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা দেখবে। রিপোর্ট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথাগত জ্ঞান, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক এবং জনশুনানির ভিত্তিতে করা হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৬০টি সভা করা হয়েছে। ১৮বার এ কমিটি মিলিত হয়েছে। আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। উঁচু মানের পেশাদারিত্বের সঙ্গে রিপোর্ট করা হয়েছে।
সুপারিশ বাস্তবায়নের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মনে রাখতে হবে যে অর্থনীতিতে মনোযোগের অভাবে রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, বিগত সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। এরপর অবকাঠামো, তৃতীয় জ্বালানি এবং চতুর্থ তথ্যপ্রযুক্তি খাত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১০০ টাকার পণ্য ১ লাখ টাকা দেখিয়ে কেনা হয়েছে। এর আগে দুর্নীতির টাকা সাধারণত দেশের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ হলেও বিগত সরকারের সময়ে বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগ যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একটি চুরির অংশ হয়ে যায়, সেটাই চোরতন্ত্র। চোরতন্ত্রের ভেতরে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দি পরা বা উর্দি ছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগ সৃষ্টি করা হয়। তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার এবং সামাজিক শক্তিকে দুর্বল করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক শক্তি অবশ করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে ছিল নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী এবং বেসরকারি খাতের লোকজন। অনেক সময় বিদেশিরা অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রশংসা করেছে। যেসব বিষয় নিয়ে প্রশংসা করেছে, তার ভিত্তি এখন সন্দেহের ভেতর রয়েছে। এ জায়গা থেকে বের হওয়ার জন্য জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংস্কারে যেতে হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা থাকা জরুরি। অন্যদিকে যদি বাজারে পণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার বিপদসংকুল হবে। এর জন্য মানুষের যে ধৈর্য দরকার, তা থাকবে না।
কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একসময় বলা হতো, মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে আছে দেশ। এটি ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। এখান থেকে বের হওয়ার তিনটি উপায়ের পরামর্শ দেন তিনি। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে বেশি। অতিমূল্যায়িত প্রকল্পের ঋণের জন্য মাথাপিছু দেনার বোঝা বাড়ছে। একসময় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থেকে বছরে ২ বিলিয়ন যেত ঋণ পরিশোধে। এখন ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার যায়। ঋণের কারণে সৃষ্ট এ সংকট এড়াতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুদের হার কমানো এবং পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রকল্পের দুর্নীতির একটা বড় অংশ একসময় দেশের ছায়া অর্থনীতিতে ছিল। পরে দুর্নীতির ৬০ শতাংশই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। পাচারেও টাকা ডলার বিনিময় হারের সুবিধা নিয়েছে তারা। অর্থাৎ দেশের যত ধরনের ক্ষতি করা যায়, সবই করা হয়েছে। তাঁর মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালও উত্তরণের পথে রয়েছে, যাদের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কারের বিরোধিতা এখনও রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে সব খাতের সংস্কার করা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, করছাড় সুবিধার ক্ষেত্রে এনবিআর কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করে না। প্রয়োজনীয় গবেষণাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। অথচ করজালের বাইরে থাকা এক কোটি করযোগ্যকে শনাক্ত করা এবং করছাড় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতে দ্বিগুণ বিনিয়োগ করা সম্ভব।
ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির সহ-উপাচার্য ড. এনামুল হক বলেন, সরকারি ব্যয়ের অন্তত ৪০ শতাংশই তছরুপ হয়েছে গত ১৫ বছরে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ম তামিম বলেন, নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন না বাড়িয়ে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
ব্র্যাক বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন দারিদ্র্যের সংজ্ঞা ও আয়বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন। এ সময় ড. দেবপ্রিয় বলেন, ৮৫ শতাংশ সম্পদের কর্তৃত্ব করছে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শারমিন্দ নিলোর্মি বলেন, বিগত সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়। জলবায়ু তহবিলের কেন স্বচ্ছতা থাকবে না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসনের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে। বিল্ডের প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগ জটিলতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
সরকারের কাছে ৫ সুপারিশ : শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার এসব বাস্তবায়ন করবে কিনা, তা সময় হলে বোঝা যাবে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে– অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকার ব্যাংকিং খাত, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্থানীয় সরকার ও নাগরিক সমাজের সুরক্ষার জন্য যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সমন্বিত ও স্বচ্ছভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। বাজেটের আগ পর্যন্ত আগামী ছয় মাস সরকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কী পরিকল্পনা নেয় এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী, তা একত্র করে পেশ করতে হবে। যেহেতু সংসদ নেই, এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকতে হবে। সেখানে মূল্যস্ফীতি, টাকার মান এবং সুদহার কোথায় পৌঁছাবে তার একটি লক্ষ্যমাত্রা দিতে হবে।
সুপারিশের মধ্যে আরও আছে– ছয় মাসের কর্মসূচির পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। ড. দেবপ্রিয় বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্থগিত করা সঠিক হয়েছে। সেখানে যেসব কাল্পনিক, অবাস্তব এবং অলৌকিক লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তার দায়িত্ব কে নেবে! যারা এটা তৈরি করেছেন, সেখানে কেবল রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিলে হবে না, পেশাদারিত্বের জবাবদিহি দিতে হবে। পরিকল্পনার একটা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে হবে। তা না হলে পরবর্তী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বা দায়িত্ববোধ আসবে না।
তিনি বলেন, আপাতত মনে হচ্ছে না, এই সরকার পাঁচ বছর থাকবে। অন্তত বছর দুয়েক থাকবে মনে হচ্ছে। আবার তা নাও থাকতে পারে। কতদিন থাকবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। তবে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে ন্যূনতম দুই বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা সামনে থাকা উচিত। মধ্যমেয়াদি ধারণা না থাকলে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
তিনি বলেন, এলডিসি থেকে বের হওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। জাতীয় আয়, মানবসম্পদ এবং ভঙ্গুরতা– তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। তথ্যের নানা অসংগতির পরও এলডিসি উত্তরণ স্থগিত করার কোনো কারণ নেই। বরং আগ্রহ সহকারে বাস্তবায়ন করা উচিত। যদি ২০২৬-এর নভেম্বরের মধ্যে বড় কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়, তখন সরকার পুনর্বিবেচনা করতে পারবে। তাঁর বিবেচনায়, বিদেশে বাজার সুবিধা পেয়ে থাকে এ রকম একটি গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে এলডিসি উত্তরণ ঠেকানোর তদবির করছে। তাদের মনে রাখতে হবে উত্তরণের পরও অন্তত তিন বছর বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে। আর অনন্তকাল বাজার সুবিধা পাওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক প্রভাবে একটি খাত ছাড়া অন্যরা তেমন প্রণোদনা পাইনি। এখন সমানভাবে প্রণোদনার মাধ্যমে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের জন্য সময় এসেছে। এ ছাড়া একটি রাজনৈতিক বিষয় আছে। যদি এলডিসি উত্তরণ না হয় তখন বলবে, ‘আমার সাজানো সোনার সংসার দুই বছরেই শেষ করে দিয়েছে।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে যারা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত তারা বিভিন্নভাবে উৎসাহিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্বেগের ভেতরে আছে। এটি নিরসনের জন্য একটি উন্নয়ন ফোরামের আয়োজন করা উচিত। উন্নয়ন সহযোগী, রপ্তানি বাজার সুবিধা দেওয়া দেশ, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং যেসব দেশ মানবসম্পদ নেয়, তাদের ডেকে আলোচনা করতে হবে। আগামী বছরের প্রথম দিকে যা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তী সরকার। বিনিয়োগকারীরা যদি না বুঝে আগামী দিনে কী হবে, তাহলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কর্মসংস্থান, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যসেবা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সমর্থন পাবে কিনা, পরিষ্কার হতে হবে। সুরক্ষা কর্মসূচির বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে।
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com