ডেস্ক রির্পোট:- বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ করে যেসব প্রেস (ছাপাখানা), সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান মালিকই সাবেক সরকারের সময়ে সিন্ডিকেট করে দরপত্রে কম দর দিয়ে বইয়ের কাজ বাগিয়ে নিতেন। এরপর দিতেন নিম্নমানের বই। কিন্তু অজানা কারণে তারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু প্রেস মালিক অবশ্য এই সিন্ডিকেটের বাইরে ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশিরভাগ প্রেস মালিকই একজোট হয়েছেন। এবার সিন্ডিকেট করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২১ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দর দিয়ে তারা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী প্রাথমিকের তিন শ্রেণির বই ছাপার কাজ পেয়েছেন। বাকি দুই শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের কাজগুলোও পেতে যাচ্ছেন। এতে সরকারের গচ্চা যাবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর লিখিত বইগুলোর দরপত্রও বাতিল হয়। পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফেরত গিয়ে সেই শিক্ষাক্রমের বইগুলো পরিমার্জনে বেশ ভালো সময় লেগে
যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফের দরপত্র দিতে গেলে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা বই পাবে না, এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দর দিয়েছেন প্রেস মালিকরা।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, বাজারদর যাচাই করে প্রাক্কলিত দর ঠিক করে এনসিটিবি। আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বইয়ের কাজ দেওয়া হতো। যেখানে ভারত, থাইল্যান্ড, চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অংশ নিত, যে কারণে কাজ পেতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর দিয়ে কাজ নিত দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে দেশীয় সিন্ডিকেটের কারণে ধীরে ধীরে এসব দেশ কাজ করতে আগ্রহ হারায়। চলতি বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আন্তর্জাতিক দরপত্র বাতিল করেছে সরকার। যার ফলে এবার দেশীয় প্রেসগুলো সিন্ডিকেট করে বেশি দামে দরপত্র জমা দিয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণি বাদে অন্য সব শ্রেণির দরপত্র হয়ে গেছে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজও শুরু হয়ে গেছে। এতে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে সরকারের ৭৮৩ কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। গত বছর যেখানে নতুন পাঠ্যবই বাবদ প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এবার সেখানে ২ হাজার কোটির বেশি খরচ হবে।
এনসিটিবি বলছে, আন্তর্জাতিক দরপত্র না থাকা এবং দেশীয় সিন্ডিকেট শক্তিশালী হওয়ায় বিগত বছরগুলোর সঙ্গে বিশাল পার্থক্য থাকলেও বেশি দর দিয়েই কাজ বাগিয়ে নিয়েছে প্রেসগুলো। পিপিআরের নিয়মের কারণে বেশি দর দেওয়া সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দিতে হয়েছে। তবে প্রেস মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, প্রেস মালিকদের কোনো সিন্ডিকেট নেই। তা ছাড়া বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং কাগজসহ অন্য পণ্যগুলোর দামের পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদ ও ট্যাক্সের হার বেড়ে যাওয়ায় এবার খরচও বেড়েছে। এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরকেও বাস্তবসম্মত মানতে নারাজ তারা।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের প্রতি ফর্মার প্রাক্কলিত দর ছিল ২ টাকা ২০ পয়সা। প্রেসগুলোর সর্বনিম্ন দর ছিল ১ টাকা ৯০ পয়সা। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের প্রাক্কলিত দর ২ টাকা ১৩ পয়সা দেওয়া হলেও প্রেসগুলো ১ টাকা ৫৪ পয়সা দর দিয়ে কাজ পেয়েছে। এ ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির ১ টাকা ৯২ পয়সা, সপ্তম শ্রেণির ১ টাকা ৮৯ পয়সা, অষ্টম শ্রেণির ১ টাকা ৮৬ পয়সা এবং নবম শ্রেণির বইয়ের প্রাক্কলিত দর ১ টাকা ৮৪ পয়সার বিপরীতে প্রেস মালিকদের দর ছিল যথাক্রমে ১ টাকা ৭০ পয়সা, ১ টাকা ৬২ পয়সা, ১ টাকা ৪৯ পয়সা এবং ১ টাকা ৪১ পয়সা। এ বছর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির প্রতি ফর্মা কাগজ ছাপানোর প্রাক্কলিত দর দেওয়া হয়েছিল ২ টাকা ৪৭ পয়সা। প্রেস মালিকরা সর্বনিম্ন দর দিয়েছেন ৩ টাকা। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির প্রাক্কলিত দর দেওয়া হয়েছিল ২ টাকা ৬১ পয়সা। প্রেস মালিকরা সর্বনিম্ন দর দিয়েছেন ৩ টাকা ৬৫ পয়সা। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ টাকা ১১ পয়সা। আর প্রেস মালিকরা সর্বনিম্ন দর দিয়েছেন ৩ টাকা ৪৮ পয়সা।
গত বছর ইবতেদায়ি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি, ষষ্ঠ শ্রেণি মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরির বইয়ের ফর্মাপ্রতি এনসিটিবির প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৯২ শতাংশ; সপ্তম শ্রেণি মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরির বইয়ের ফর্মাপ্রতি প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং অষ্টম শ্রেণি মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরির বইয়ের ফর্মাপ্রতি প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১৫ শতাংশ কম দর দিয়েছিলেন প্রেস মালিকরা। তবে এ বছর সেটি বেড়ে গেছে। ইবতেদায়ি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি, ষষ্ঠ শ্রেণি মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরির বইয়ের ফর্মাপ্রতি প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে যথাক্রমে ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, ২১ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি দর দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছর নতুন শিক্ষাক্রমের বই গেছে। যেখানে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই চার রঙে মুদ্রিত। কিন্তু আগামী বছরের বই যেহেতু পুরোনো শিক্ষাক্রমের, সে কারণে প্রাথমিকের বইগুলো চার রঙে মুদ্রিত হবে। তবে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং নবম ও দশম শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের বইগুলো চার রঙে মুদ্রিত হবে। এ ছাড়া বাকি সব বই ছাপা হবে এক রঙে, সাদাকালোতে। আবার বইয়ের ব্রাইটনেসও (উজ্জ্বলতা) কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরও বেশি দর দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা।
এনসিটিবিতে একসময় কর্মরত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা বলেন, বাজারে কাগজ ও কালির দাম খুব বেশি বাড়েনি। মনিটরিং সিস্টেম আগের মতোই আছে। তার পরও এনসিটিবি ও প্রেসগুলো বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে বলে একটি মনগড়া কাহিনি দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এক জিনিস আর ওভার প্রাইসিং (অতিরিক্ত দাম) আরেক জিনিস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির এক সদস্য বলেন, বইয়ের মানের বিষয়ে এবার আমরা কোনো ছাড় দেব না। আগে প্রেস মালিকরা কম দামে কাজ নিয়ে কোনোরকম কাজ করে জমা দিতেন। এবার তারা জানেন সেটি পারবেন না। যে কারণে আগের চেয়ে দর বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা এটিও জানেন, সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এমন একটি সময় টেন্ডার করা হয়েছে, বই ঠিক সময়ে দিতে গেলে রি-টেন্ডার করার সময় নেই। তারা এটির সুযোগ নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, প্রেস মালিকরা এবার সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন। যেহেতু আমাদের সময় কম, ফের দরপত্র করার মতোও পর্যাপ্ত সময় নেই। যে কারণে প্রতিটি শ্রেণিতে ২০ শতাংশের মতো বেশি দামে কাজ দিতে হয়েছে। ফলে আমাদের ধারণার চেয়ে প্রায় ৭৮৩ কোটি টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক টেন্ডার না থাকায় দেশীয় প্রেস মালিকরা এবার এ সুযোগটা নিয়েছেন। এবার গতবারের তুলনায় বই বেশি ছাপাতে হচ্ছে। তা ছাড়া কাগজের দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে খরচ কিছুটা বেড়েছে।
তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দরে কাজ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান রবিন বলেন, এনসিটিবি নিজেদের মতো করে একটা প্রাক্কলিত দর ঠিক করে। আগের বছরগুলোয় যে দর ছিল, একই দরে এ বছরও প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করেছে। এটি বাস্তবসম্মত নয়। ফলে তাদের নির্ধারিত দরে কাজ করা সম্ভব হয় না। আবার এ বছর কাগজসহ ছাপার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের দাম, ব্যাংক ঋণের হার ও ট্যাক্সের পরিমাণ গতবারের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে দর আগের চেয়ে বেড়েছে। এখানে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটের বিষয় নেই।
আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দামের ওপর নির্ভর করে টেন্ডারের রেট দিই। এনসিটিবি যে অভিযোগ করেছে, সেটি সত্য নয়। এনসিটিবি হয়তো শুধু কাগজের দামের ওপর নির্ভর করে এস্টিমেটেড কস্ট নির্ধারণ করেছে। এর সঙ্গে কালি, গ্লুসহ অনেক কিছুর দামই যোগ করতে হয়। এ বছর যে মানের কাগজ চাওয়া হয়েছে, সেগুলো পাল্প ছাড়া সম্ভব নয়। কাগজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তার সুযোগ নিচ্ছেন মিল মালিকরা।কালবেলা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com