ডেস্ক রির্পোট:- ঢাকা ওয়াসার ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ৬টি প্রকল্পে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রকল্পের টাকা নয়-ছয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, গত বছর অনুসন্ধানে নেমে অনিয়মের বিষয়ে বেশকিছু নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব নথি সংগ্রহকালে ওয়াসার ৪০ জনেরও বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুদক। তবে রহস্যজনক কারণে সে অনুসন্ধান আর বেশি এগোয়নি। দুদক সূত্র বলছে, অতিরিক্ত ব্যয়, ঠিকাদার নিয়োগে ঘুষ, চুক্তিভিত্তিক পদ তৈরি করে পছন্দমতো নিয়োগসহ নানা কায়দায় বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটের অভিযোগ রয়েছে ওয়াসার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের একটি দল গত বছর থেকে অনুসন্ধানে নেমেছে। সংস্থাটির উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধান করছে। একই সঙ্গে ১২ কর্মকর্তার মধ্যে ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে তারা প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্ট থাকার কথা বলেছেন। আর সেই সূত্র ধরে একটি তালিকা তৈরি করছে দুদক। তালিকা অনুযায়ী ওয়াসার কর্মকর্তা কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পরিকল্পনা থাকলেও তা আর হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওয়াসার কর্মকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করলেও নথিপত্র ভিন্ন কথা বলছে। অভিযোগ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ওই কর্মকর্তারা আরও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করেছেন। যাদের নিয়ে অনুসন্ধানটি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। তবে এতবড় অনুসন্ধান নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ প্রকল্পে ২০ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ঢাকা ওয়াসা। এর কোনোটিই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিটি প্রকল্প থেকেই তছরুপ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। আর সব ক্ষেত্রেই এ কাজে জড়িত ছিল ১২ সদস্যের ওই চক্র। এর মধ্যে ৪ জন ওয়াসায় নিয়োগ পেয়েছিলেন অবৈধভাবে। নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পান অন্য দু’জন। এ ছাড়াও অবৈধভাবে নিয়োগের পাশাপাশি নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পাওয়ার অভিযোগ আছে আরেকজনের বিরুদ্ধে। আর এসব কারসাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।
অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ৪ জন হলেন- ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) মো. আবুল কাশেম, পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন, সহকারী সচিব মৌসুমী খানম ও ডেপুটি চিফ ফাইন্যান্স অফিসার রত্নদ্বীপ বর্মণ। এর মধ্যে পরিচালক (উন্নয়ন) ও পরিচালক (কারিগরি) পদ দু’টি ওয়াসার অর্গানোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত না। পরিচালক আবুল কাশেম অবসরে যাওয়ার পর ৯ বছর ধরে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। আরেক পরিচালক এ কে এম এম সহিদ উদ্দিনও অবসরে যাওয়ার পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ছিলেন। সম্প্রতি এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা ইতিমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছেন। গত এক বছরেও এই মামলাটির অনুমোদন দেয়নি দুদক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, এ ব্যাপারে মামলার সুপারিশ দেয়া হলেও আইনগত কিছু কোয়ারিজ দেয়া হয়েছে কর্মকর্তাকে। কারও বিরুদ্ধে মামলা করে দিলেই তো শেষ হয়ে গেল না। আমরা চাই যেকোনো কাজ যেমন অনুসন্ধান, তদন্ত কিংবা চার্জশিট দেয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি না থাকুক।
প্রকল্পের টাকা লুটপাটে নাম এসেছে ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা প্রকৌশলী জয়নাল আবেদীন ও প্রকৌশলী মুস্তাফিজুর রহমান, গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আল আমিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্টাফ অফিসার প্রকৌশলী বদরুল আলম এবং সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের। ২০১৯ সালে উদ্বোধন হওয়া পদ্মা জশলদিয়া পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন রফিকুল। শুধু এ প্রকল্পেই ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদকের তথ্যানুযায়ী, ওয়াসার প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হচ্ছে না। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়। নকশা ও বিবরণ অনুযায়ী কাজ করা হয় না। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়েও দুর্নীতি হচ্ছে।
যেসব প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ:
৩ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা জশলদিয়া পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্প উদ্বোধন হয় ২০১৯ সালে। ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর চাপ কমানোর উদ্দেশ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মার তীরে এ পানি শোধনাগার নির্মাণের মাধ্যমে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, নবাবপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর ও সংলগ্ন এলাকায় পানির চাহিদা পূরণই প্রকল্পটির লক্ষ্য। কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। এ প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ এক দফা বাড়ানো হয়। সংশোধিত প্রকল্পে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। এটি এখন ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকার প্রকল্প। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
২০১৩ সালে ঢাকা মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশন মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ওয়াসা। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ রোধে ৫টি শোধনাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রকল্পের অনুমোদন হয় ২০১৫ সালে। ওই বছরেরই জুলাইয়ে শুরু হয় কাজ। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। শুরুতে প্রকল্পের খরচ ছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এতে খরচ বাড়ে প্রায় ৩ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। যেখানে সরকারি তহবিল থেকে ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসা ১০ কোটি টাকা এবং প্রকল্প সহায়তা থেকে ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। স্বল্প পরিসরে ২০২২ সালের জুনে চালু হয়েছে পয়ঃশোধনাগারটি। এ প্রকল্পেও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
গুলশান-বারিধারা লেক দূষণমুক্তকরণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে। ২০১২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয় ২০১৪ সালের জুনে। ৫৪ কোটি টাকার প্রকল্পটি ৫ কোটি টাকা কম ব্যয় করেই, অর্থাৎ ৫০ কোটি টাকাতেই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে দুদকের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। তথ্যানুযায়ী ব্যয় দেখানো পুরো টাকাই নয়ছয় হয়েছে।
১ হাজার ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হয়েছে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-২) প্রকল্প। ২০১২ সালের ১৩ই ডিসেম্বর এ শোধনাগার উদ্বোধন হয়। শোধনাগার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রতিবছর ১৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। সেই হিসেবে প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে ১৮০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
২০১৬ সালের ২৪শে মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয় ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইম্প্রুুভমেন্ট প্রজেক্ট বা ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩ হাজার ১৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পরে ৫৯৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা টাকা। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মেয়াদ ছিল। সংশোধিত প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি না থাকলেও কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। শুরুর পর থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকাই নয়ছয় হয়েছে।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com