ডেস্ক রির্পোট:- মীরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনাগুলো যেন মৃত্যুকূপ! প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষাকালে ঝরনায় পানি বেশি থাকায় পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত না করা, পাহাড়ি পথ সম্পর্কে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা না থাকা, সাঁতার না জানা, প্রশিক্ষিত গাইডের অভাবে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। গত সাত বছরে মীরসরাইয়ের ঝরনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৩ পর্যটক।
জানা গেছে, মীরসরাই উপজেলায় খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা, মেলখুম ট্রেইল, বোয়ালিয়া ঝরনা ও মহামায়া বুনো ঝরনা দেখতে আসেন দূরদূরান্তের পর্যটকরা। পাহাড়ের শরীর লেপ্টে টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে গিয়ে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। অসতর্কতা ও সাঁতার না জানার কারণে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। পর্যটনস্পটগুলোতে অব্যবস্থাপনা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রকৃতিপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
মীরসরাইয়ে বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থিত পাঁচটি প্রাকৃতিক ঝরনা ইজারা দেয় বন বিভাগ। বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে ঝরনাগুলো দেখাশোনা করা হয়। প্রত্যেক বছর ইজারামূল্য বাড়লেও পর্যটকদের জন্য এখনও নিরাপদ হয়ে ওঠেনি ঝরনাগুলো। ঝরনা এলাকায় নেই পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঠিকাদারের কাছে ঝরনা ইজারা দিয়ে দায় সারে বন বিভাগ। প্রতি বছর এসব ঝরনা দেখতে এসে প্রাণ হারাচ্ছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ভ্রমণ পিপাসুরা। মৃত্যু ঠেকাতে গত বছর মেলখুম ট্রেইল ও চলতি বছরের গত ২৮ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে বন বিভাগ। সংস্কার শেষে গত ৪ অক্টোবর খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটকদের জন্য পুনরায় উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
স্থানীয়দের দাবি, ঝরনা দেখতে আসা সিংহভাগ পর্যটক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া। তাদের মধ্যে অনেকে সাঁতার না জানার কারণে ঝরনার নীচে থাকা কূপে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন।
মীরসরাইয়ের ঝরনায় যাওয়ার পথগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে বর্ষামৌসুমে পাহাড়ি পথ পিচ্ছিল থাকায় দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এছাড়া ঝরনা এলাকায় পর্যটকদের জন্য নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশ্রামাগার ও শৌচাগার। কোনও অবকাঠামো উন্নয়ন না করে বন বিভাগ থেকে ঝরনা ইজারা দেওয়া অযৌক্তিক এবং অমানবিক বলে দাবি পর্যটকদের। ঝরনায় যাওয়া পথ ভালো না হওয়ায় কোনও পর্যটক দুর্ঘটনায় শিকার হলে তাদের উদ্ধার করতে সময় লেগে যায় উদ্ধারকর্মীদের। এতে করে প্রাণহানি বেড়ে যায়। নানা প্রতিকূলতা ও অব্যবস্থাপনায় গত সাত বছরে এসব ঝরনায় ২৩ জন পর্যটক প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। এছাড়া গাইড ছাড়া বিভিন্ন ঝরনায় যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে যাওয়া শতাধিক পর্যটককে উদ্ধার করেছে জোরারগঞ্জ থানা ও মিরসরাই থানা পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস টিম। তবুও টনক নড়েনি ইজারাদার ও বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের।
সর্বশেষ এ বছর ৪ অক্টোবর উপজেলার রূপসী ঝরনায় ছবি তুলতে গিয়ে কূপের পানিতে ডুবে মুশফিকুর রহমান আদনান (২১) ও মাহবুব রহমান মুত্তাকিম (২১) নামে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। মুশফিকুর রহমান আদনান ঢাকা ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ও মাহবুব রহমান মুত্তাকিম নারায়ণগঞ্জ কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। গত ২৭ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনায় ছয় জন ঘুরতে এসে পাথর পড়ে মাহবুব হাসান (৩০) নামে ওয়ান ব্যাংক কর্মকর্তা মারা যান ও গাজী আহমেদ বিন শামস (৩৫) নামে আরেকজন গুরুতর আহত হন। তারা সহকর্মী ছিলেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনার কূপে ডুবে সিফাতুর রহমান মজুমদার (২০) নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তিনি ইউনির্ভাসিটি অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। চলতি বছরের ২০ আগস্ট খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কুমিল্লার লালমাইয়ের ছোট শরিফপুর এলাকার বাসিন্দা অঞ্জন বড়ুয়া (২১) ও একই এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল হক (২২) নামে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়। অঞ্জন বড়ুয়া কুমিল্লা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ও ফয়সাল হক কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি খৈয়াছড়া ঝরনা থেকে পা পিছলে কূপে পড়ে শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আল শাহরিয়ার আনাস (২২) মারা যান।
২০২৩ সালে দুই জন নিহত ও একজন আহত হন। একই বছরের ২৭ জুন সোনাইছড়ি ঝরনা দেখতে এসে পথভ্রষ্ট হন ১৫ পর্যটক। এ সময় জরুরি সেবায় যোগাযোগ করে সাহায্য চান তারা। পরে মীরসরাই থানা-পুলিশ ও ফায়ার সাভির্সের কর্মীরা দুর্গম পাহাড় থেকে তাদের উদ্ধার করেন।
২০২২ সালের ১৯ জুন মীরসরাইয়ের নাপিত্তার ছড়া ঝরনায় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) স্নাতকের ছাত্র মাসুদ আহম্মেদ তানভীর, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেধাবী ছাত্র তৌফিক আহম্মেদ তারেক ও চট্টগ্রাম ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেধাবী ছাত্র ইশতিয়াকুর রহমান প্রান্তের মৃত্যু হয়। এছাড়া ওই বছর আহত হন আরও তিন জন।
২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনার ওপর থেকে পড়ে আহত হন একজন। ২০২০ সালে খৈয়াছড়া ঝরনা ও নাপিত্তাছড়া ঝরনায় দুই জনের মৃত্যু ও চার জন আহত হন। ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল খৈয়াছড়া পাহাড়ি এলাকায় ঝরনার ওপর থেকে পা পিছলে পড়ে মো. আশরাফ হোসেন (৩০) নামে এক যুবক মারা যান। ২৮ জুন খইয়াছড়া ঝরনায় ওপর থেকে পড়ে মৃত্যু হয় আনোয়ার হোসেন নামে এক পর্যটকের। ১২ জুলাই বোয়ালিয়া ঝরনা দেখতে আসা ১৫ ছাত্রছাত্রী অসতর্কতার জন্য ঝরনার পথে ছরায় পানি বেড়ে যাওয়ায় আটকা পড়েন। পরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। ১৭ জুলাই মহামায়া লেকের পানিতে ডুবে মারা যান শাহাদাত হোসেন (২২)। ২৬ জুলাই অসতর্কভাবে ছবি তুলতে গিয়ে খইয়াছড়া ঝরনায় আবু আলী আল হোসাই মেমোরী (৩০) নামে প্রকৌশলীর মৃত্যু হয়। ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে আসা মেহেদী হাসান (২২) নামে একজন প্রকৌশল ছাত্রের মৃত্যু হয় রুপসী ঝরনায়। ২৯ আগস্ট দেলোয়ার হোসেন নামে চট্টগ্রামের এক পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। ৪ সেপ্টেম্বর ফেনী থেকে আসা ফয়েজ আহমদ নামে এক পর্যটক পা পিছলে পড়ে মারা যান। আহত হয়েছেন কমপক্ষে চার জন। ২০১৮ সালে ১৫ আগস্ট নাপিত্তার ছড়া ঝরনার কূপে ডুবে অনিমেষ দে (২৭) নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়। ২৪ আগস্ট বড়কমলদহ রূপসী ঝরনায় ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক। ১৫ জুলাই খইয়াছড়া ঝরনার পঞ্চম স্তরে ওঠার পর স্থানীয় এক পর্যটক পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সময় তাকে ধরতে যান ওয়াসিম আসগর নামে অপর এক পর্যটক। ওই পর্যটক সামান্য আঘাত পেলেও ওয়াসিম পাহাড়ের নিচে পড়ে যান। এতে মারাত্মক আহত হন তিনি। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর নাপিত্তার ছড়া ঝরনায় সাঁতার কাটার সময় চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন মামুন (২২) মৃত্যু হয়। ১২ জুলাই উপজেলার বোয়ালিয়া ঝরনা দেখতে এসে আটকা পড়েন ১৫ পর্যটক। চার ঘণ্টা চেষ্টার পর তাদের উদ্ধার করে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিসের একটি দল। এছাড়াও ঝরনার ওপর থেকে পড়ে আহত হন আরও শতাধিক পর্যটক।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে ঝরনাগুলোর ইজারা দেয় বন বিভাগ। ওই বছর ১২ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে ২৯ লাখ টাকায় ইজারা নেন এএইচ এন্টারপ্রাইজ। চলতি বছর ৩০ লাখ টাকায় ইজারা নেন সোমোশন এন্টারপ্রাইজ। গত ৩ বছরে ঝরনাগুলোর ইজারামূল্য বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
সোমোশন এন্টারপ্রাইজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে থাকা শাহরিয়ার মাহমুদ আসিফ বলেন, ‘ঝরনায় আসা বেশিরভাগ পর্যটক এলাকাটি সম্পর্কে অবগত নন। তাই প্রত্যেক পর্যটককে আমরা গাইড নিতে উৎসাহিত করি। প্রতিটি গাইডের জন্য সর্বনিম্ন ৪শ’ টাকা মজুরি ধরা হয়। এরমধ্যে গাইড ও পর্যটকরা দরদাম ঠিক করেন। তবে গাইড নেওয়াটা বাধ্যতামূলক না হওয়ায় কোনও পর্যটককে গাইড ছাড়া প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া যায় না। পর্যটকরা অসর্তক থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।’
মীরসরাই ফারার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা ইমাম হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ‘মীরসরাইয়ের প্রাকৃতিক ঝরনাগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরনায় পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত না করা ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে প্রবেশাধিকার বন্ধ না করা, পাহাড়ি পথ সম্পর্কে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা না থাকা, সাঁতার না জানা, প্রশিক্ষিত গাইড নিয়ে ঝরনায় না যাওয়া ও প্রর্যাপ্ত গাইডের অভাব, ঝরনায় গিয়ে সেলফি তোলা, বর্ষাকালে পাহাড়ে ভ্রমণের কারণে বাড়ছে প্রাণহানি।’
বন বিভাগের জোরারগঞ্জ বিট কর্মকর্তা একরামুল হক বলেন, ‘পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মেলখুম ট্রেইল গত বছর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপরও পর্যটকরা বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে ভেতরে প্রবেশ করেন। কোনোভাবে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করা যাচ্ছে না।’
পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বারৈয়াঢালা রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, ‘পর্যটকদের টিকিট দেওয়ার সময় বিপদজ্জনক স্থানগুলোতে না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া বন বিভাগ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে না যেতে ঝরনার প্রবেশ পথে ফেস্টুন দেওয়া হয়েছে। গাইড ছাড়া ঝরনায় যেতে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ইতমধ্যে খৈয়াছড়া ঝরনায় মৃত পাথর অপসারণ ও সংস্কার শেষে পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের সময় ও বৃষ্টির পরপরই ঝরনা এলাকায় না যাওয়া উত্তম। এ সময় পাথরগুলো পিচ্ছিল থাকে। সাঁতার জানা না থাকলে ঝরনার কোমর পানিতে নামা ও ঝরনার ঝুঁকিপূর্ণ উপরের স্তরগুলোতে উঠা নিষেধ।’
মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা প্রশাসক মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘বন বিভাগ থেকে ইজারাশর্তে নিরাপত্তার মৌলিক বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে প্রানহানি অনেকটাই কমে আসবে। পর্যটকদেরও নিজেদের সতর্ক থাকার কোনও বিকল্প নাই। নিষিদ্ধ স্পটগুলোতে কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা থেকে পর্যটকদের বের হয়ে আসতে হবে।’ট্রিবিয়ন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com