বান্দরবান:- বান্দরবান জেলার বিভিন্ন শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে লক্ষ্মীপদ দাশ এবং মোজাম্মেল হক বাহাদুরের বিরুদ্ধে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে এ বছরের জুন মাসে লক্ষ্মীপদ দাশ এবং মোজাম্মেল হক বাহাদুরের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় প্রচারমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরা দুজনসহ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর এপিএস সাদেক হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাধা দেওয়ার অভিযোগে থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়।
এ ছাড়া সরাসরি মামলা না হলেও পলাতক আছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সদ্যবিলুপ্ত লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল এবং আলীকদম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লক্ষ্মীপদ দাশ বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক বাহাদুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। তারা দুজনই বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার ভাগাভাগি এবং বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্য করে তারা গত ১৫ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
লক্ষ্মীপদ দাশ বান্দরবান শহরে একটি আলিশান বাড়ি করেছেন। ইটের ভাটা আছে তার। তিনি একটি বেসরকারি ক্লিনিকের অংশীদার এবং চেয়ারম্যান।
দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য লক্ষ্মীপদ বেড়ে ওঠেন তীব্র অভাব-অনটনের সংসারে।
তার বাবা উপেন্দ্র দাস বান্দরবান উপজেলার একটি লন্ড্রি দোকানে ধোপার কাজ করতেন। বাবার বসতভিটার জায়গা ছাড়া আর কোনো সহায়সম্পদ ছিল না। সংসারের হাল ধরতে লক্ষ্মীপদ দাস তাই পাড়ি জমান প্রবাসে। সেখানে গিয়ে নিজেও শুরু করেন ধোপার কাজ। কিন্তু প্রবাসে তেমন সুবিধা করতে না পেরে চলে আসেন দেশে।
যুক্ত হন রাজনীতিতে। আগে থেকে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকার সুবাদে ১৯৯৮ সালে বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ পান। এই পদটি পাওয়ার পর যেন পেয়ে যান আলাদীনের চেরাগ। এরপর ধীরে ধীরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরবর্তিতে নির্বাচিত হন জেলা পরিষদের সদস্যও। এরপর ক্ষমতার দাপটে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে অল্প সময়ে লক্ষ্মীপদ হয়ে যান কয়েক কোটি টাকার মালিক। বিপুল টাকা খরচ করে দেশ ও দেশের বাইরে কিনেছেন ফ্ল্যাট, বাড়িসহ অঢেল সম্পদ।
অভিযোগ রয়েছে, লক্ষ্মীপদ বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালীন একটি ঠিকাদার সমিতি গঠন করেন। ওই সমিতির স্বঘোষিত সভাপতি হন তিনি। পরে প্রভাব ও কৌশল খাটিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন। পরে ওই সমিতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। লক্ষ্মীপদ দাশ জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ থেকে শুরু করে সব বিভাগে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
লক্ষ্মীপদের রয়েছে বান্দরবান সদরে রাজারমাঠের পাশে দৃষ্টিনন্দন বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়া বিলাসবহুল বাড়ি। বালাঘটা পাসপোর্ট অফিসের পাশে কিনেছেন কোটি টাকা মূল্যের ১৬ শতক জমি। লেমুঝিরি এলাকায় রয়েছে নামে-বেনামে অর্ধকোটি টাকার জমি। রেইচা চিনিপাড়ায় এক কোটি টাকা মূল্যের জমি। কালাঘাটা এলাকায় রয়েছে দেড় কোটি টাকা দামের এক একর জমি। ঢাকা ও ভারতের কলকাতায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। বান্দরবান সুয়ালকে রয়েছে তার ব্যক্তিগত অবৈধ ইটভাটা। বান্দরবান শহরে প্যারিস প্যারাডাইস ভবনে (বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে) লক্ষ্মীপদ দাসের স্ত্রী শিক্ষক সীমা দাসের নামে কোটি টাকা মূল্যের দুটি দোকান প্লট রয়েছে।
অন্যদিকে, মোজাম্মেল হক বাহাদুরের বিরুদ্ধে দাপট খাটিয়ে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি জেলা শহরে একটি ৫তলা বাড়ি, চট্টগ্রাম শহরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বিপুল পরিমাণ জমির মালিক। অভিযোগ রয়েছে, বাহাদুর ও তার ভাইয়েরা মিলে টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো অনিয়ম নেই যা তারা করেননি। জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে বাহাদুর ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে। বাহাদুর সাত বছরে শূন্য থেকে শতকোটি টাকার মালিক বনে যান। তার আগে বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদ ইউনিয়নে। বাবার দরজির কাজের সুবাদে বান্দরবানে তাদের আগমন। পরে ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে এসে ঠিকাদারি শুরু করেন তিনি। কিন্তু ঠিকাদারিতে কোনো সুবিধা করতে পারেননি বাহাদুর। জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর হয়ে গেলেন আঙুল ফুলে কলাগাছ।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বান্দরবান পৌরশহরে ৬ কোটি টাকা মূল্যের জায়গা কিনে আরও ১০ কোটি টাকা খরচ করে ৬ তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করেছেন বছর দুই আগে। সূত্র জানায়, তার ৬তলা ভবনের ষষ্ঠ ফ্লোরের কোনো অনুমোদনও নেই। বান্দরবান সদর ইউনিয়নের টঙ্কাবতী সড়কে প্রতি একর ২০ লাখ টাকা করে ৩০০ একর জায়গা কিনেছেন তার নামে এবং ভাইদের নামে যে জায়গাগুলোর মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের ওয়াসার মোড়ে ১০ কোটি টাকায় দুই হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্লোর কিনে গড়েছেন ‘বাহাদুর টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্স’। তা ছাড়া মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের শেয়ার কিনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হয়েছেন বলেও জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং-এর সাবেক এপিএস সাদেক হোসেন চৌধুরী ছাত্রলীগ বান্দরবান কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হন। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ দিন উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালনকালে নানা তদবির এবং প্রকল্প বাগিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন।
দৃশ্যত বান্দরবান জেলা সদরে পৈত্রিক ভিটা ছাড়া তার আর কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। তবে নামে-বেনামে কয়েকটি মাইক্রোবাস, জিপের মালিক এবং রাজধানীতে তার একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে ৫ আগস্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দিন থেকেই তারা পলাতক। বন্ধ রাখা হয়েছে তাদের মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সাথে সংযোগের সব লিঙ্ক। ফলে এসব অভিযোগের বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ এবং বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে বান্দরবান সদর থানায় যে দুটি মামলা রুজু করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সেগুলো এখনো তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
বান্দরবান জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমী জানিয়েছেন, বিভিন্ন অভিযোগ এবং মামলার কারণে আমরা অভিযুক্তদের খুঁজছি। কিন্তু পলাতক থাকায় আটক করে আইনের আওতায় এখনো নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। তবে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে আমরা ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছি বলে জানান জেলা পুলিশের মুখপাত্র।
এদিকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জায়গার ৩৮ জন নেতার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগনামা/স্মারকলিপি দিয়েছেন বান্দরবান জেলা বিএনপি নেতা মজিবুর রশিদসহ ২৭ জন নেতাকর্মী।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, অভিযোগপত্রটি সাথে সাথেই দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বান্দরবানের বর্তমান ছাত্রলীগ গঠিত হয়েছে পাঁচ মাস আগে। ফলে তারা কেউ অনিয়ম, টেন্ডারবাজির সাথে যুক্ত হবার আগেই ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে যায়।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সামসুল ইসলাম এবং সাবেক সভাপতি রাশেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তারা পলাতক না হলেও মিডিয়া থেকে দূরত্ব রেখে চলছেন। বন্ধ রেখেছেন মোবাইল ফোনও। ফলে অভিযোগের বিষয়ে তাদের বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com