ডেস্ক রির্পোট:- চট্টগ্রামে পতিত নিকৃষ্টতম স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার দোসরদের অনেকে এখনও গ্রেফতার হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবে গণহত্যায় মদদ দান, লুটপাট, অর্থপাচার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়নসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় সুস্পষ্ট অভিযোগও আনা হয়েছে। তবে তাদের গ্রেফতারে বিগত আড়াই মাসেও কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি র্যাব-পুলিশ।
বিগত দেড় দশক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির ওপর চেপে বসা ফ্যাসিবাদি শাসনে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপিদের অনেকে রীতিমত দানবে পরিণত হয়। সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, দলীয়করণ এবং আত্মীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার, সরকারি জমি, বন, নদী, খাল, পাহাড় দখল থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই যা তারা এবং তাদের সহযোগীরা করেনি। নিজ নিজ এলাকায় তাদের কথাই ছিল আইন। তাদের ইশারা ছাড়া নড়েনি গাছের পাতাও। তাদের বাহিনীর কাছে সাধারণ মানুষ ছিল জিম্মি। প্রশাসন ছিল তাদের হুকুমের গোলাম, পুলিশ ছিল দলীয় লাঠিয়ালের ভূমিকায়।
তাদের চরম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা। তাদের ইশারায় বিরোধী দলের অনেক কর্মী শিকার হয়েছেন গুম-খুনের। মিথ্যা ও সাজানো মামলায় আসামি হয়ে বছরের পর বছর কারাবরণ করেছেন। বাড়ি-ঘরছাড়া হয়েছেন অনেকে। পতিত স্বৈরাচারের মন্ত্রী, এমপিদের মধ্যে চরম ঘৃণিত হিসাবে ব্যাপক কুখ্যাতি অর্জন করেন বেশ কয়েকজন। তারা হলেন-সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ১৪ দলীয় জোটের শরিক তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর ভান্ডারি, জালিয়াতির ভোটে ঘোষিত সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্চু সামশু, বাঁশখালীর সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার আবু রেজা নদভী, রাউজানের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী জুনু। তাদের মধ্যে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে ধরা পড়েছেন জুনু। বাকিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন।
এসব ঘৃণিত আওয়ামী গডফাদারদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ওপর ভয়ঙ্কর হামলার অভিযোগও রয়েছে। কেউ কেউ ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদি হাসিনার স্বৈরশাসনকে শেষ সময় পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার অপচেষ্টা করে গেছেন। ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন এক গণঅভ্যূত্থানে বিগত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তার ‘আপন ঠিকানা’ ভারতে পালিয়ে যান। এরপর তার সহযোগী স্বৈরাচারির দোসরদের গ্রেফতারে শুরু হয় অভিযান। কিন্তু চট্টগ্রামে ফ্যাসিবাদি হাসিনার দস্যুদের বেশির ভাগই অধরা রয়ে গেছে।
তারা গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে বিশেষ করে হাসিনার পতন আন্দোলনে শহিদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ-অসন্তোষ বেড়েই চলেছে। তাদের কেউ ভারতসহ বিদেশে পালিয়েছেন, কেউ আবার দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের কয়েকজন সাগরে কোস্টার জাহাজে আশ্রয় নিয়েছেন বলেও জোর গুঞ্জন রয়েছে। তবে র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। তাদের প্রত্যাশা এসব অপরাধীরা ধরা পড়বেন।
বিগত দেড় দশক হাছান মাহমুদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল চট্টগ্রামে। বিশেষ করে তার নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়া ছিল তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের কাছে জিম্মি। তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপির বিরুদ্ধে চরম বিষোদগার করা ছিল হাছান মাহমুদের প্রতিদিনের রুটিন। তার কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যে সাধারণ মানুষও ছিলো চরম বিরক্ত, বিক্ষুদ্ধ। লুটপাট আর অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অনেক সম্পদের মালিক হাসিনার এই দোসর এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
আওয়ামী দুঃশাসনে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে পারদর্শী ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান। স্বঘোষিত ইসকনের সদস্য স্বৈরাচারের এই দোসর ছিলেন চরম ইসলাম বিদ্বেষী। দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের অন্যতম কারিগর মহিবুল প্রতিনিয়ত জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে চরম ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য রাখতেন। উপমন্ত্রী থাকাকালে চট্টগ্রামে জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের নামফলক তুলে নেওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন তিনি। ওই জাদুঘর বন্ধের দাবিও তোলেন। তার অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি ছিল নগরবাসী। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার বাহিনীর ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে তার বাহিনীর ক্যাডারেরা। ‘ছাত্রদের আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’-ঢাকায় ওবায়দুল কাদেরের এমন হুক্কারের পর চট্টগ্রাম ছাত্র-জনতার উপর হামলে পড়ে মহিবুল হাসানের লালিত ক্যাডার ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলনে ১১ জন শহীদ হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনায় জড়িত ছিল তার বাহিনীর ক্যাডারেরা। এসব ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় মহিবুল হাসান ও তার ক্যাডারদের আসামি করা হয়েছে। ক্যাডারদের অনেকে ইতোমধ্যে ধরা পড়লেও অধরা থেকে গেছে মহিবুল। তার অবস্থান সম্পর্কেও পুলিশ এখনও অন্ধকারে।
স্বৈরাচারী হাসিনার মাফিয়া শাসন টিকিয়ে রাখতে ভারতের নির্দেশে বরাবরই সহযোগীতা করেছে জাতীয় পার্টি। আর পার্টির হয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তিনি হলেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বিনিময়ে তিনি ভোট ছাড়াই চট্টগ্রামের হাটহাজারী আসন থেকে বার বার এমপি হয়েছেন। ভারতে ইচ্ছায় হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দুই হাতে কামিয়েছেন অর্থ। জুলাই মাসে শুরু হওয়া গণআন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন তিনি হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখেন।
একই ভূমিকায় ছিলেন বিতর্কিত ব্যক্তি নজিবুল বশর ভান্ডারি। অনেক ঘাটের পানি খাওয়া এই ব্যক্তি ছাত্র-জনতার আান্দোলন দমনে শেখ হাসিনার গণহত্যার অন্যতম সহযোগী ছিলেন। সরকারের শেষ সময়েও তিনি গণভবনে গিয়ে সরকারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার বদলে নগদ টাকা গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নৌকায় উঠে ভোট ছাড়া এমপি হয়ে ফটিকছড়িতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন ভান্ডারি ও তার পরিবারের সদস্যরা। তাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন দলের পরিত্যক্ত সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাহিনী। তাদের কাছে জিম্মি ছিল সাধারণ মানুষ। সেই ভান্ডারি ও তার বাহিনীর সদস্যরা এখনও ধরা পড়েনি।
প্রহসনের নির্বাচনে মেয়র হওয়ার পর লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এম রেজাউল করিম ছাত্র আন্দোলন দমনে ক্যাডার বাহিনীর নামিয়েছিলেন। আর এই কারণে ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়েন তিনি। হাসিনার পতনের আগেই তার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। বিগত ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে ছাত্র-জনতা ওপর যেসব ক্যাডার প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ করেছে সেখানে রেজাউলের ক্যাডারেরাও ছিলেন। ওই ঘটনার পর সিটি কর্পোরেশনে সভা করে কাউন্সিলর নামধারী সন্ত্রাসীদের নিয়ে এলাকায় এলাকায় ছাত্র-জনতাকে প্রতিরোধে কমিটি গঠন করেন রেজাউল। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, হাসিনার পতনের পর পালিয়ে যান রেজাউল ও তার বাহিনীর ক্যাডারেরা। গুঞ্জন ছিল ৫ আগস্টের পর রেজাউল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়েন। তবে এখনও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তার সর্বশেষ অবস্থা এবং অবস্থান সম্পর্কেও কোন তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।
পটিয়ার এমপি হয়ে মাদক ব্যবসা, দখলবাজি, সরকারী অর্থ লুটপাটসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান বিচ্চু শামসু ও তার ছেলে। তাদের কাছে পটিয়ার মানুষ ছিল রীতিমত জিম্মি। আওয়ামী লীগের লোকজন এক পর্যায়ে তার লুটপাট ও খুন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। দুদকে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। বিচ্চু ছিল এলাকার ত্রাস। হাসিনার পতনের পর আড়ালে চলে গেছেন এই দুর্নীতিবাজ।
আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়ে নিজ নিজ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন মোস্তাফিজুর রহমান ও আবু রেজা নদভী। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় সিন্ডিকেট গঠন করে দখল, লুটপাট ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠে। মোস্তাফিজুর রহমান নিজেকে বাঁশখালীর মালিক মনে করতেন। সেখানে নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ওসিসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা তার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। তার বিরোধীতা করে মামলায় ফেঁসেছেন অনেকে। এমনকি সাংবাদিকরাও রক্ষা পাননি তার কালো থাবা থেকে। জামায়াত থেকে ডিগাবাজি মেরে টাকার বস্তা দিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে যান নদভী। এরপর নিজের স্ত্রী ও শ্যালকদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট, তাদের কথায় ছিল সেখানে আইন। ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী এই নদভী কোথায় তা জানেন না কেউ।ইনকিলাব
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com