ডেস্ক রির্পোট:- ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তংসই খুমী। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখালেন এই তরুণী। কারণ বাংলাদেশে তাঁর আগে খুমী সম্প্রদায়ের আর কোনো ছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাননি।
খুমীদের প্রথম মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েতবে নিজ জনগোষ্ঠীর উদাহরণ হতে গিয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে দুর্গম পাহাড়ে বেড়ে ওঠা এই তরুণীকে।
তবে মায়ের মুখে হাসি দেখে সেই কষ্টের কথা ভুলে গেছেন তংসই। বললেন, ‘আমাদের মতো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা বাধা ঠেলে এত দূর আসতে হয়েছে আমাকে। মা পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন।
পারেননি। মা যা পারেননি, বহু কষ্টে তা আমার মাধ্যমে পূরণ করেছেন। তাঁর মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে বেশি আনন্দ লাগছে।’ চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় তংসই।
তাঁর মেজো ভাইটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়ছেন। সবার ছোট বোনটি সামনে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। বাবা নয়লো খুমী ছিলেন স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক। জুমচাষও করতেন। তবু সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাত।
গ্রামজুড়ে শুধু নেই আর নেই
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম তারাছা ইউনিয়নের বাসিন্দা তংসই। গ্রামের নাম মংঞো পাড়া। বান্দরবান শহর থেকে দূরত্ব ৮০ কিলোমিটারের বেশি। বান্দরবান শহর থেকে সড়কপথে সরাসরি যাওয়া যায় ঘেরাও বাজার পর্যন্ত। এরপর সাঙ্গু নদী পার হয়ে নামতে হয় মংঞো পাড়া নদীর ঘাটে। সেখান থেকে জঙ্গলঘেরা পাহাড় বেয়ে তংসইদের বাড়ি যেতে আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটাপথ।
বন-পাহাড়ের গ্রামটিতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎও পৌঁছায়নি। নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক, হাসপাতাল বা স্কুল। সংসারে অভাব বারো মাস। এত অভাবের মাঝেও স্বপ্নটুকু ছিল নয়লো খুমীর। নিজেও বেশিদূর পড়তে পারেননি তিনি। কিন্তু চেয়েছিলেন সন্তানদের যতদূর সম্ভব পড়াবেন।
বাবার ছায়াও সরে গেল
তখন সবে পাঁচে পড়েছেন তংসই। নয়লো খুমী তাঁর মেয়েকে পাঠালেন ঢাকার একটা খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে। সেখানেই হাতেখড়ি। বছর দুয়েক পর আবার চলে আসেন বান্দরবানে। তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলেন বান্দরবান কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সপ্তম শ্রেণিতে উঠে স্কুল বদলালেন। এবার তাঁর ঠিকানা বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলে এসে প্রথম ধাক্কা খেলেন ভাষা নিয়ে। শিক্ষকরা যা বলেন কিছুই বুঝতে পারেন না। তখন ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করতেন। পরে অবশ্য ভাষার সমস্যা কেটে গেল। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় মাথার ওপর থেকে সেই বাবার ছায়াও সরে গেল!
কঠিন ছিল সেসব দিন
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে যেন অথই সাগরে পড়লেন তংসইয়ের মা লিংসাই খুমী। তিন সন্তান বেসরকারি স্কুলে পড়ে। তাঁদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। পরে তিনজনকে নিয়ে ভর্তি করালেন সরকারি স্কুলে। লিংসাই খুমী কখনো জুমে কাজ করতেন, কখনো বা নিজেদের পোশাক বুনতেন। কিন্তু এভাবে একা আর পেরে উঠছিলেন না। তবে কখনো সন্তানদের পড়াশোনায় ছেদ পড়তে দেননি। এমন কষ্টের মধ্যেই মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.১১ পেয়ে এসএসসি পাস করলেন তংসই। ভর্তি হলেন ঢাকার হলিক্রস কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৪.০০ পেলেন।
তিনিই প্রথম
পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর তুলনায় বেশ পিছিয়ে খুমীরা। বান্দরবানভিত্তিক এই জনগোষ্ঠীর মানুষ আছে প্রায় তিন হাজার। এদের প্রায় ৯৬ শতাংশের পেশা জুমচাষ। ফিলিপ গায়েন সম্পাদিত ‘খুমী : প্রান্তের আদিবাসী’ শিরোনামের বই থেকে জানা যায়, খুমীদের সাক্ষরতার হার প্রায় ২৮ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের হার প্রায় ২২ শতাংশ। এই সম্প্রদায়ের কোনো তরুণী এর আগে দেশের কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। ফলে অন্য জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন ছিল তংসইয়ের জন্য। সামনে কোনো উদাহরণও ছিল না। তবে বৃত্ত ভাঙার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মনে ছিল অন্য ভয়—ভর্তি প্রস্তুতিসহ পড়াশোনার খরচ চালাবেন কিভাবে? সেই যাত্রায় সহায় হলো জুম একাডেমি। বিনা পয়সায় সেখানে কোচিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তংসই।
পরে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। যদিও শেষে ভর্তি হয়েছেন নৃবিজ্ঞান বিভাগে।
ভাইয়ের নামও ইতিহাসে
শুধু তংসই নয়, তাঁর বড় ভাই সুইতং খুমীর নামও লেখা হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। কারণ, খুমী সম্প্রদায়ের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা প্রথম ব্যক্তি সুইতং। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে মাস্টার্সে পড়ছেন তিনি।
সন্তানের এই কৃতিত্বের বিষয়ে মা লিংসাই খুমী বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে ছেলেমেয়েদের বড় করেছি। আমাদের সময় মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। তাই নিজে পড়তে পারিনি। কিন্তু মেয়ে আমার স্বপ্নপূরণ করেছে। ভীষণ আনন্দ লাগছে।’
তংসইয়ের সাফল্যে আনন্দিত তাঁর ভাই সুইতং খুমী বলেন, ‘খুমীদের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা তো আরো পিছিয়ে। আশা করছি, তংসইয়ের দেখানো পথে খুমীদের অনেক তরুণী উঠে আসবে।’
এখন নতুন দুশ্চিন্তা
ধারদেনা করে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নেবেন কী করে—এখন সেই চিন্তা পেয়ে বসেছে তংসইকে। বললেন, ‘অভাবের সঙ্গে লড়ে এত দূর এসেছি। সামনে পড়াশোনা কিভাবে চালাব, তা নিয়ে চিন্তায় আছি। এ ব্যাপারে কারো সহযোগিতা পেলে ভালো হতো।’
ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা অর্জনে দেশের বাইরে যেতে চান তংসই। আর চান খুমী সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ করতে। যাতে আরো বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী উঠে আসে।কালের কন্ঠ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com