ডেস্ক রির্পোট:- আগামী দিনের রাজনীতিতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত নির্যাস ধারণ করতে চায় বিএনপি। ফ্যাসিবাদের বিদায়ের পর তিন দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটি রাজনৈতিক কলা-কৌশলে ইতোমধ্যে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। জন আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির লক্ষ্যে ২০২৩ সালে ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ যে ৩১ দফা দলটি ঘোষণা করেছিল, সেটিকে তারা এ ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। এই ৩১ দফাকে দলটির পরবর্তী নির্বাচনেরও ‘ম্যানিফেস্টো’ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা আলাপকালে বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট চলে আসছে, সেটির আর পুনরাবৃত্তি চান না তারা। আগামীর বাংলাদেশ হবে স্থিতিশীল বাংলাদেশ, যেখানে সুষম গণতন্ত্রের চর্চা হবে, থাকবে মানুষের বাক ও মৌলিক স্বাধীনতা। এ জন্য রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার, সেটা তারা রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে আনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিএনপির নেতারা এও বলেছেন, শুধু রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রেই নয়, দলের অভ্যন্তরেও তারা গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে চান। এ ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের কিভাবে আরো জবাবদিহির আওতায় আনা যায়, সেই চেষ্টা তারা করে যাচ্ছেন। একই সাথে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে সেই ক্ষমতার সঙ্গে যারা জড়িত থাকবেন, তাদেরকে কিভাবে কঠিন জবাবদিহির ভেতরে রাখা যায়, সেটিও রয়েছে তাদের ভাবনায়।
সূত্র জানায়, ৩১ দফার ভিত্তিতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায় বিএনপি। এ জন্য দেশজুড়ে এই দফাগুলোর প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। এই প্রচার-প্রচারণার লিফলেটে ৩১ দফা যেমন তুলে ধরা হচ্ছে, তেমনি ধানের শীষ প্রতীককে আগামী দিনে আবারো বেছে নেয়ার বার্তা দেয়া হচ্ছে। ৩১ দফার ওপর দলের নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়েছে, যেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই সংযুক্ত থেকে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। গত বুধবার রাতে এমনই এক কর্মশালায় তারেক রহমান বলেছেন, ‘গত ৫ আগস্টের আগের প্রেক্ষাপট ছিল একরকম, এখন অন্যরকম। বিএনপি জনগণের দল, এই দলের কাছে প্রত্যাশাও অনেক। তাই ভবিষ্যতে আমরা কী করবো, কিভাবে করবো তা জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তুলে ধরতে হবে। আমরা লড়েছি, আমরাই গড়বো, এমন আত্মবিশ^াস সবার মধ্যে থাকতে হবে’।
বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা’র রূপরেখাগুলোর শিরোনামে স্থান পেয়েছে- সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় সমন্বয় কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা নির্ধারণ, আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সংশোধন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন, জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন ও সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন, মিডিয়া কমিশন গঠন, দুর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ, সর্বস্তরে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন, ধর্মীয় স্বাধীনতার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা প্রদান, মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা শ্রমের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, শিল্প, বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানি খাত আধুনিকায়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা, বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বশাসিত ও ক্ষমতাবান করা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান, আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ, চাহিদা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নীতির বাস্তবায়ন, কৃষকের উৎপাদন ও বিপণন সুরক্ষা দিয়ে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, সড়ক, রেল, নৌ পথের আধুনিকায়ন ও বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ এবং নদী শাসন ও খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণ করা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তির উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং যুগোপযোগী, পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব আবাসন এবং নগরায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
তারেক রহমান ওই প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছেন, ‘৩১ দফা এমন বিষয় নয় যে এগুলো পরিবর্তন করা যাবে না। সময়, কাল, দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে আমরা এর মধ্যে পরিবর্তন আনবো। নতুন নতুন বিষয় এটাতে আমরা সম্পৃক্ত করবো।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা’র রূপরেখা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষিত ‘১৯ দফা’, বিএনপি চেয়াপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘২৭ দফা’ কর্মসূচির আলোকে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংশোধিত ও সম্প্রসারিতরূপে প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এই রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়- ভবিষ্যতে ‘একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠন করা হবে, যারা রাষ্ট্রের রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে। ৫ আগস্টের পরেও দলটি একই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
বিএনপির প্রতিশ্রুত এই রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠনে মাঠে নেমেছে বিএনপির তিন অঙ্গসহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। ‘আমরা যদি থাকি সৎ-দেশ সংস্কার সম্ভব’ শীর্ষক সেøাগান এবং সাম্য ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সারা দেশে চলছে ৩১ দফা এবং ধানের শীষের প্রচার-প্রচারণা। এর মধ্য দিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাঙা করা ও সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়ানোরও চেষ্টা করা হচ্ছে।
৫ আগস্টের পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কর্মসূচিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। দলটি এখন সামাজিক নানা কর্মসূচিতে মনোযোগ দিয়েছে। দলীয় নেতাদের ভালো কাজ দিয়ে মানুষের মন জয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন হবে খুবই কঠিন। সেই বাস্তবতা মাথায় নিয়ে প্রত্যেক নেতাকর্মীকে পথ চলতে হবে। কোনো অন্যায়-অনিয়মের সাথে সম্পৃক্ত হলেই নেয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা ।নয়াদিগন্ত
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com