ডেস্ক রির্পোট:- পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবার জাতীয় সম্মেলন (কাউন্সিল) নিয়ে ভাবছে বিএনপি। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পরপর সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা। তবে প্রায় ৯ বছরেও কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দমনমূলক নীতি, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদার আচরণকে দায়ী করে থাকে বিএনপি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সম্মেলন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। এতে করে দল এবং সারা দেশের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা ও উজ্জীবিত হবেন বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকে আলোচনাও হয়েছ। আজও আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে। নীতিনির্ধারণী এই বৈঠকে কাউন্সিলের দিনক্ষণ নির্ধারণ নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য ৯ বছরে শুধু কাউন্সিলই নয়, বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিগুলোও গঠন করতে পারেনি দলটি। ফলে দলীয় নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়ছেন অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা। আবার এক নেতার দখলে রয়েছে একাধিক পদ। এতে বিএনপিতে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না বলে পদপ্রত্যাশী ও তৃণমূল নেতাদের দাবি। জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে কিছু বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকীয় পদ আছে। কিন্তু পদে থাকা নেতাদের কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। এজন্য বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিগুলো করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় । তারা কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। তবে তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা চলছে। তারিখ নির্ধারণ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের দুঃশাসনের কারণে গত আট বছরে কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ কাউন্সিলের পর ২০১৮ ও ২০২৪ সালে দুটি জাতীয় নির্বাচন একতরফাভাবে অভিনব কায়দায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার জাতীয় কাউন্সিল
করার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, সব মিলিয়ে ৯ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে অন্তত তিনটি কাউন্সিল করা যেত। এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কাউন্সিলের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকলেও বিষয়টি আলোচনায় আছে। কেননা, কাউন্সিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। কয়েক মাস সময় লাগে। এখন সিদ্ধান্ত নিলেও তিন-চার মাস পর কাউন্সিল করতে হবে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির অবস্থা
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করে বিএনপি। সম্মেলনের প্রায় পাঁচ মাস পর ৬ আগস্ট ঘোষিত কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অনেক তরুণ, নতুন মুখ এবং নারী নেত্রীরা পদ পান। ছাত্রদলের সাবেক শতাধিক নেতাকেও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ দেওয়া হয়। জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে স্থায়ী কমিটির পদ ১৯টি (চেয়ারম্যান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ) উপদেষ্টা কাউন্সিলের পদ ৭৩টি, ভাইস চেয়ারম্যান ৩৫টি, যুগ্ম মহাসচিব ৭টি, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক মিলে ৫৯২টি পদ রয়েছে। যেখানে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় ঘটে। কাউন্সিলের পর ৪৯৬ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে কিছু পদে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেই পদোন্নতি এবং নতুনভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই সম্মেলনের পর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে ৫টি পদে শূন্যতা তৈরি হয়। তবে গত ১৬ আগস্ট দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। ফলে আরও তিনটি পদ ফাঁকা থাকল। বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৮টি পদ, উপদেষ্টা পরিষদের ২০টি এবং সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক মিলে আটশর মতো পদ খালি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মধ্যে আইন, যুব, জলবায়ু পরিবর্তন, মহিলা, ছাত্রবিষয়ক সহ-সম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা সহ-সম্পাদকের পদ খালি রয়েছে। তন্মধ্যে যুববিষয়ক ও ছাত্রবিষয়ক সহ-সম্পাদকের পদ আট বছরেও পূর্ণ হয়নি। আর বাকিগুলো পদোন্নতি, মৃত্যু, বহিষ্কার এবং পদত্যাগজনিত কারণে শূন্য হয়েছে। বিএনপি সূত্র জানায়—বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও কয়েকজন সদস্য ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। নির্বাহী কমিটির অনেকে অসুস্থ ও বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয়। অনেকেই জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করায় কেন্দ্রে সময় দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রে থাকলে এলাকায় সময় দিতে পারেন না। ফলে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ এবং একেক নেতার এক পদ কার্যকর করা সময়ের দাবি বলে মনে করে দলটির নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনের পর দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা গেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করেছেন। এরপর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও থাকেন না তিনি। নব্বই-ঊর্ধ্ব জমির উদ্দিন সরকার বৈঠকে থাকার চেষ্টা করেন। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মামলার সাজার কারণে বিদেশে রয়েছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা এবং দলীয় জনশক্তির পদায়নের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক একাধিক উপকমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু জাতীয় সম্মেলনের ৯ বছরেও তা সম্পন্ন করতে পারেনি দলটি। বিষয়ভিত্তিক ২৬টি উপকমিটি গঠনের কথা বিএনপির গঠনতন্ত্রে বলা আছে। মাত্র দুটি উপকমিটি গঠিত হলেও এর কার্যক্রম নিয়ে দলের অভ্যন্তরেই রয়েছে নানা প্রশ্ন। ফলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গবেষণাসহ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিএনপিকে বেগ পেতে হয়। সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল এবং অঙ্গসংগঠনের কমিটির পুনর্গঠন করা হলেও বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি গঠনের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ফলে একদিকে দলীয় নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়ছেন অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা। আবার এক নেতার দখলে রয়েছে একাধিক পদ। এতে বিএনপিতে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না বলে পদপ্রত্যাশী ও তৃণমূল নেতাদের দাবি। জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে কিছু বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকীয় পদ আছে; কিন্তু পদে থাকা নেতাদের কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। এজন্য বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিগুলো করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
৯ বছরেও হয়নি বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি
বিএনপির গঠনতন্ত্র ঘেঁটে জানা যায়, সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে ২৬টি উপকমিটি গঠনের কথা বলে হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি প্রসঙ্গে দলটির গঠনতন্ত্রের ৬নং অনুচ্ছেদের ১৩নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘দলের চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনবোধে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কমিটি মনোনীত করতে পারবেন। ওই উপধারায় আরও বলা হয়েছে, কমিটিগুলোয় দলের সদস্য নন অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী, যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন এমন ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।’
তবে এ সময়ের মধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট ‘নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম’, ২০২২ সালের ২০ জুন ‘মিডিয়া সেল’ গঠন করা হয়। ২০২৪ সালের ২২ মার্চ ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ নামে পৃথক একটি সেল গঠন করেছে বিএনপি। এর বাইরে আর কোনো কিছুই করতে পারেনি দলটি।
তবে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর বিষয়ভিত্তিক সাব-কমিটি গঠনের লক্ষ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ কাজ শুরু করেন। তারা ১০ সদস্যবিশিষ্ট ১৩টি বিষয়ক কমিটির খসড়া প্রস্তুত করেন। কিন্তু, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে অবস্থান করায় উপকমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটি বেশিদূর এগোয়নি। এরপর বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত কমিটি করার কথা বলা আছে। বিএনপির গঠনতন্ত্রে বলা আছে, জাতীয় কাউন্সিলে দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচিত হবে। এ কমিটি নির্বাচিত হবে তিন বছরের জন্য। সে হিসেবে ২০২২ সালের মার্চের মধ্যে দলটির আরও দুটি কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটিও হয়নি। যদিও দলটির নেতাদের দাবি, সরকারের দমন-পীড়নের কারণে কাউন্সিল করা যায়নি। এখন দল শক্তিশালী ও পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে নানামুখী তৎপরতা নিয়েছে বিএনপি। তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, ওলামা দল, ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরীর কমিটি ভেঙে নতুনভাবে কমিটি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে মৎস্যজীবী দলের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। গত শনিবার থেকে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা যৌথভাবে সারা দেশে কর্মিসভা করছেন।কালবেলা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com