ডেস্ক রির্পোট:- আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে সবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠে পুলিশ। সর্বত্র সমালোচনার মুখে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এ বাহিনী। সরকার পতনের পর জনরোষ এতটাই ভয়ংকর হয়– রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের ২২৪টি স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে ভাঙচুর করা হয় আরও ২৩৬টি পুলিশ স্থাপনা। বেশ কিছু থানা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। দেড় মাসের বেশি সময় পার হলেও পুলিশে এখনও চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর ‘যুদ্ধ’। ভেঙে পড়া মনোবল ফিরে পেতে কঠিন সংগ্রামে আছে পুলিশ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে রয়ে গেছে বিশৃঙ্খলা। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর খোলনলচে বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গেল সাড়ে ১৫ বছরের দুর্নাম ঘুচিয়ে পুলিশ জনআস্থা অর্জন করতে চায়। এ লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ আটটি সংস্কার কমিটিও কাজ করছে। অন্যদিকে, পুরো পুলিশ বাহিনী সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশন বাহিনী সংস্কারে তিন বিষয়ে প্রাধান্য দেবে।
এদিকে পুলিশের কয়েকশ স্থাপনা ও যানবাহনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশে এখনও পুলিশ স্বাভাবিক টহল কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। কিছু থানায় নিজস্ব একটি যানবাহনও অক্ষত নেই। অন্য থানা থেকে দু-চারটি গাড়ি এনে কোনো রকমে চলছে থানার কাজ। ফৌজদারি মামলা ও জিডির সংখ্যা নিম্নমুখী। অনেক ভুক্তভোগী থানায়ই যাচ্ছেন না। চলমান বাস্তবতায় পুলিশের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর নানা চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে রয়েছে– বাহিনী সংস্কারের পাশাপাশি সদস্যদের মনোবল ফেরানো, নিরপরাধ সদস্যদের মামলা-ভীতি কাটানো ও নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করা।
পুলিশসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ১১ সেপ্টেম্বর ছয়টি কমিশন গঠন করে। আগামী মাসে কাজ শুরু করবে এ কমিশন। ডিসেম্বরে তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। পরে এসব প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় পর্যালোচনার পর উন্মুক্ত করা হবে। পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে।
পুলিশ সংস্কারের ব্যাপারে জানতে চাইলে সফর রাজ হোসেন বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারের ব্যাপারে সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমরা বসব। সবার মতামত নেওয়া হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের পাশাপাশি কিছু সংস্কার কার্যক্রমের সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ থাকে। আমরা সব ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব করব। এটা বাস্তবায়ন করবে সরকার। পুলিশ সংস্কার কমিটিতে ১০ জন সদস্য সরকার ঠিক করে দেবে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর আমরা সবাই বসব।’
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘পুলিশের জন্য জরুরি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করা। পুলিশের কোনো সদস্য গুরুতর অপরাধে জড়ালে বাহিনীর বাইরে আলাদা একটি কমিটি থাকবে, যারা এর তদন্ত করবে। এই কমিটির যেন শাস্তির সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকে– এটা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের আচরণে সমস্যার বিষয়ে কাজ করতে হবে। নিয়মকানুন মেনে পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতি শতভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হতে হবে।’
ঢিলেঢালা টহল, অভিযোগ কম
দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনও পুলিশ স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারেনি। অনেক থানায় নেই টহল গাড়ি। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে ভুক্তভোগীর অভিযোগ সংখ্যা কমেছে। যদিও প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল, খুন, মারামারির ঘটনা ঘটছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর রাজধানীর ৫০ থানায় মামলা হয়েছে ২৫ হাজার ৫১টি। প্রতি মাসে গড় জিডি ছিল ১৭ হাজার ৮১৫টি। গত আগস্টে ঢাকায় মামলা হয়েছে ৫০৭টি। এই মাসের গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত রাজধানীতে মামলা হয়েছে ৮৬৩টি। গত বছর ঢাকায় জিডি হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৮৪টি। গড়ে প্রতি মাসে জিডি হয়েছে ১৭ হাজার ১৮৫টি। গত আগস্টে রাজধানীর ৫০ থানায় জিডি হয়েছে ৭ হাজার ৯০টি। আর গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জিডি হয়েছে ৫ হাজার ৭২৯টি। ঢাকায় যত মামলা হয়, এর বড় একটি অংশ মাদকের। তবে টহল কার্যক্রমে ধীরগতি ও পুলিশের ঢিলেঢালা ভাবের কারণে অনেক এলাকায় চলছে ধুমছে মাদক কারবার। গতকাল দুপুরে মিরপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো থানা ভবন লন্ডভন্ড। কিছু গাড়ির সরঞ্জাম পুড়ে কঙ্কাল। থানা ভবন ও ভবনের পেছনে থাকা পুলিশের চার তলা সরকারি বাসভবনেরও একই হাল। আবাসিক ভবনের প্রায় সবকিছু লুট করা হয়েছে, আর নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভবনের সামনে থানা অনেক মোটরসাইকেল।
থানার পেছনে একটি কোয়ার্টারে চলছে থানার কার্যক্রম। মিরপুর থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন বলেন, সব কিছু গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। আগে থানায় টহলের জন্য ৮টি গাড়ি ছিল। সব গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য থানা থেকে ৪টি গাড়ি এনে টহলের কাজ চলছে। মিরপুর থানায় আগস্টে মামলা হয়েছে ২৫টি। আর এ মাসে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৩৬টি।
মাঠ পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা
মাঠ পর্যায়ের একাধিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক জায়গায় অধস্তন সদস্যরা বাহিনীর কমান্ডারদের নির্দেশনা ঠিকঠাক পালন করছেন না। এতে জনবিশৃঙ্খলা ঠেকাতে মাঝে মাঝে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সর্বশেষ গত রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সারোয়ার জাহানকে মোবাইল ফোনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘এভাবে ফোর্স চালানো যায় না, স্যার। কেউ কথা শুনছে না। এভাবে পুলিশ চলতে পারে না।’ কাকরাইলে অডিট ভবনের সামনে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করা অডিটরদের সরিয়ে দিতে অধীনস্থ এসআই, কনস্টেবলদের অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সারোয়ার জাহান। তবে সারোয়ারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঠিকঠাক কাজ করছিলেন না পুলিশ সদস্যরা। এ ব্যাপারে পুলিশের এক এএসআই বলেন, ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তার নির্দেশনা মানতে গিয়ে ছোট পদের অনেক সদস্য বিপাকে পড়েছেন। তাই এখন নির্দেশনা প্রতিপালনে অনেকে গড়িমসি দেখাচ্ছেন।
এসআই পদে ৭৫ শতাংশ পদোন্নতির ভিত্তিতে
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের নন-ক্যাডার সদস্যরা ১১ দফা দাবি তোলেন। এর মধ্যে রয়েছে– পুলিশের ঝুঁকি ভাতা বাড়ানো, টিএ-ডিএ বিল প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে পরিশোধ এবং প্রযোজ্য সব সেক্টরে সোর্সমানি নিশ্চিত করা। পুলিশ সদস্যদের বার্ষিক ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি বাড়িয়ে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ৬০ দিন করা। দেশ ও জনগণের স্বার্থে ছুটি ছাড়া সম্ভব না হলে অভোগ ছুটির বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়া। এর পাশাপাশি পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে তাদের দাবি ছিল। এ প্রেক্ষাপটে পুলিশ সদর দপ্তর ৮টি আলাদা কমিটি গঠন করে। এরই মধ্যে কমিটির সদস্যরা একাধিক সভা করেছেন। পুলিশের পোশাক বদলের কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়েছে। এ ছাড়া এএসআই থেকে এসআই পদে ৭৫ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকি ৩০ শতাংশ এসআইকে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হবে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল রানা বলেন, ‘পুলিশের ৮টি কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা সংস্কার প্রস্তাব পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে জমা দেব।’
কেমন চলছে থানা
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট পর্যন্ত ডিএমপির কোতোয়ালি থানার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এর পর থেকে থানায় মামলা, জিডি ও আসামি গ্রেপ্তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এই সময়ের মধ্যে হত্যাসহ ২৬টি মামলা এবং ৩১৪টি জিডির ভিত্তিতে ২৮ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে থানা পুলিশ।
সোমবার দুপুরে থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের কক্ষে দুই ব্যক্তি বসে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মোবাইল ও গাড়ির কাগজপত্র হারানোর জিডি করতে এসেছেন। রাজন নামে এক চালক আসেন তাঁর গাড়ির কাগজপত্র হারানোর অভিযোগ নিয়ে।
এদিকে দুপুর ২টার পর তমা চৌধুরী নামে এক নারী কোতোয়ালি থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে আসেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বামীর সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদ হওয়ার পর তাদের জমানো টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, বিষয়টি ফয়সালা করতে তিনি থানায় এসেছেন।
সোমবার রাত সাড়ে ৯টা শাহবাগ থানায় ঢুকতেই আর্মড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি দেখা যায়। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে থানায় আসেন ভুক্তভোগীরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন ডিউটি অফিসার তুলসী। দেখা যায়, অভিযোগ শোনার পর কীভাবে জিডি বা অভিযোগ লিখতে হবে– সেটা ব্রিফিং দিয়ে দিচ্ছেন।
এদিকে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ফোনে হুমকি-ধমকির বিষয়ে অভিযোগ দিতে থানায় আসেন। অল্প সময়ের মধ্যে তারা অভিযোগ দিয়ে চলে যান।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে পল্টন থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা ভবনের নিচতলায় মেরামতকাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। থানা ভবনের পাশে টিনশেডে ডিউটি পোস্টে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বসে আছেন। এ সময় রেশন কার্ড ও মোবাইল ফোন হারানোর বিষয়ে জিডি করতে আসেন দু’জন। জিডি করতে চাইলে পুলিশ সদস্যরা আধা ঘণ্টা পরে আসতে বলেন। একথা শুনে ক্ষুব্ধ হন এক ভুক্তভোগী। থানার সেবা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
পল্টন থানা সূত্রে জানা যায়, আগস্টে ১৫টি এবং সেপ্টেম্বরে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এই সময়ে জিডি হয়েছে ১ হাজার ৬৩৮টি। যার মধ্যে অধিকাংশই হারানোর অভিযোগ। সমকাল
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com