ডেস্ক রির্পোট:- নিষ্পাপ শিশুটির চোখে-মুখে শূন্যতা। মায়ের আদরমাখা স্পর্শ তাকে আর ছুঁয়ে যায় না। ছোট কোমল হাতে মাকে স্পর্শ করতে না পারার যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে। টলমলো চোখে খুঁজছে তার মায়ের মুখটি। জন্মের পঁচাত্তর দিন পর হারাতে হয় মাকে। ২০শে জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় গুলিতে মারা যান বিশ বছর বয়সী সুমাইয়া আক্তার। তিনি তার একমাত্র শিশু সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পর ঘুম পাড়িয়ে বেলকনিতে দঁড়িয়েছিলেন। এ সময় ভবনটির ছয়তলার বারান্দার গ্রিল ছিদ্র হয়ে তার মাথায় এসে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢলে পড়েন মেঝেতে।
নিহত সুমাইয়ার মা আসমা বেগম বলেন, আমার নাতনিটাকে কী জবাব দিবো। সে তো অবুঝ, মায়ের অভাব বুঝতে পারলেও মুখ ফুটে বলতে পারছে না কাউকে। ওইদিন নতুন মহল্লার আশেপাশের সবাই গুলি ও হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পায়। অনেকে তখন বারান্দা, ছাদ এবং জানালায় ছুটে যায় দেখার জন্য। আমার মেয়েও তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বাসার উত্তর দিকের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এ সময় গ্রিল ভেদ করে বুলেটটি এসে সুমাইয়ার মাথায় লাগে। দুই বছর আগে বিয়ে হয় মেয়েটার। বাচ্চার বয়স এখন চারমাস চলে। সুমাইয়া যখন মারা যায় তখন ওর বয়স আড়াইমাস ছিল।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ নতুন মহল্লায় সুমাইয়াদের ভাড়া বাসায় গেলে তার মা বারান্দার গ্রিলে থাকা বুলেটের ক্ষত চিহ্নটি দেখিয়ে কাঁদছিলেন। ঘরে মধ্যে সবখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মেয়ের স্মৃতি। একমাত্র নাতনিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, মা আর সন্তান কী জিনিস সেটা ভাষায় বোঝানোর মতো না। আমি হারিয়েছি আমার বুকের সন্তানকে। আমার নাতনি হারিয়েছে তার মাকে। মায়ের কষ্টটা ওর কী কখনো পূরণ হবে। আমার মেয়েটা খুব শান্ত ছিল নিজের কষ্ট সবসময় লুকিয়ে রাখতো। সুমাইয়ার বাচ্চা হওয়ার পর এত খুশি ছিল যেটা বলার বহিরে। সব বসময় মেয়েকে নিয়ে হাসিখুশিতে কেটে যেতো। মেয়েটিও ওর মাকে মাত্র চিনতে শিখেছিল। মেয়ের জন্য বেশি লাল জামা পছন্দ করতো সুমাইয়া। আমাকে এমন কিছু বলে যেতেও পারেনি আমার মেয়েটা। আমার মেয়েটা বলে যেতে পারেনি যে মা আামি চলে যাচ্ছি আমার মেয়েটিকে দেখে রেখো। গুলি লাগার পরেই নিচের দিকে ঢলে পড়ে যায়।
আশপাশের বাসিন্দারা জানান, ঘটনার দিন বিকাল পাঁচটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি ভবনে আগুন দেয়ার পর থেকে হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি শুরু হয়। ওই ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় পুলিশ সদস্যরাও থাকতেন। আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় আওয়ামী লীগ কর্মীরাও সেখানে আশ্রয় নেয়। ভবনের ভেতরে আটকে থাকা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গুলি চালায়। এতে অনেক লোক নিহত ও আহত হয়।
ওইদিনের ঘটনার বর্ননা দিয়ে তিনি বলেন, ২০শে জুলাই সন্ধ্যায় ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল। চারিদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। একটার পর একটা র্যাব, পুলিশের হেলিকপ্টার ঘুরছিল। এটা দেখার জন্য সবাই উৎসুক ছিল। আমার মেয়ে তার বাচ্চাটিকে পাশের রুমে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমাকে বলে সবাই দেখছে আমি একটু দেখি মা। গিয়ে পাশের রুমের বেলকনিতে দাঁড়ায়। তার কিছুক্ষণ পরে আমি একটা শব্দ শুনতে পাই। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার মেয়ে বেলকনিতে ঢলে পড়ে আছে। চিৎকার দিয়ে উঠে ওর কাছে দৌড়ে যাই। তখন ওর মাথাটা বেলকনির দরজার কাছে এসে পড়ে। মাথায় হাত দিয়ে উঠিয়ে দেখি প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকি। আমার ছেলেরা এসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে পাগলের মতো হয়ে যায়। তারা কী করবে, কোথায় নিবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রক্ত বন্ধ করতে একটা কাপড় দিয়ে মাথায় বেঁধে দেই। যখন হাত দিয়ে গুলিবিদ্ধ জায়গা চেপে ধরি তখন ওর নাক দিয়ে রক্ত ছোটা শুরু করে। তখনই মনে হয়েছে আমার মেয়ে আর বাঁচবে না। এ সময় ঘরে থাকা সবাই দিকবিদিক হয়ে পড়েছিল। এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল মেঝে পুরো লাল হয়ে যায়। এম্বুলেন্স আনার জন্য সবাইকে বলি, জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিলে সেখানেও কাউকে পাওয়া যায়নি। আশেপাশের মানুষ তখন অনেকে আসে। সবাইকে বলি আমার মেয়েটাকে একটু ধরেন। লোকজনকে বলি মেয়ের হাতটা একটু দেখেন ও বেঁচে আছে নাকি। সবার হাতে-পায়ে ধরেছি মেয়েটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু বাইরে যে পরিস্থিতি ছিল তারাইবা কী করবে।
তিনি বলেন, এ সময় আমার বড় মেয়ে বাসার নিচে গিয়ে রিকশাচালকদের হাতে-পায়ে ধরেছে। পরে একজনের দয়া হলে সে রাজি হয় হাসপাতালে নিতে। আমার ছেলেরা ও একজন ভাড়াটিয়া ধরে ছয়তলা থেকে নামিয়েছে আমার মেয়েকে। যতদূর নেমেছে সিঁড়িতে ততদূর রক্ত পড়তে পড়তে গেছে। পরে আমার দুই ছেলে ও মেয়ে সাইনবোর্ড প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মেয়ের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিতে চেয়েও পারিনি। এরপর সবার পরামর্শে সিদ্ধিরগঞ্জ কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত নেই। সেখানে দাফন করতে গেলেও ছিল আতঙ্ক। আমার মেয়েকে দাফন করতে গেলে ছাত্রলীগের লোকজন বাধা দেয়। তারা বলে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধদের দাফন করতে দিবে না। অনেক হেনস্তা করেছে আমাদের।
আসমা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় থাকি। আমাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ। নদীতে আমাদের বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ওদের বাবা সেলিম মাতুব্বর করোনার সময় মারা যায়। তখন সন্তানেরা ছোট ছিল। কাঁচপুরে একটি টেক্সটাইল মিলের নিরাপত্তারক্ষী ছিল।
তিনি বলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঝামেলার কারণে সুমাইয়া তাদের বাসায় থাকতেন। তার মৃত্যুর পর কয়েকদিন পর সুমাইয়ার স্বামী মেয়েকে এসে দেখে যান। নাতনীকে কৌটার দুধ খাওয়ানো হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ছেলেরা কিছু কাজ করে তা নিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। এখন এই দুধের শিশুটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা দুঃশ্চিন্তায় আছি। মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com