বান্দরবান:- বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা। বিগত ১৬ বছরের চেয়ারম্যানিতে এমন কোনো অনিয়ম নাই যা তিনি করেননি। নিয়োগ, বদলি, টেন্ডার, জমি ও প্লট বাণিজ্য থেকে শুরু করে বান্দরবান জেলা পরিষদের ২৮টি ন্যস্ত বিভাগের প্রত্যেকটি প্রকল্পের কাজে তাকে আগে পার্সেন্টেজ দিতে হতো। না হয় প্রকল্পের বিল আটকে রাখত দিনের পর দিন।
এভাবে প্রায় হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা। পুরো বান্দরবানে প্রায় ৮শ একর জমিরও সন্ধান পাওয়া গেছে তার নামে-বেনামে এবং স্ত্রীর নামে। সদর উপজেলার রামজাদী নামক স্থানে জমিসহ প্রায় ২০ কোটি টাকা দামের বাড়ি নির্মাণ করেছেন চীন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে।
এর আগে ১২ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে ‘অস্তিত্বহীন প্রকল্প দেখিয়ে ৭২০ কোটি টাকা লুট’ শিরোনামে বান্দরবান জেলা পরিষদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে একে একে বেরিয়ে আসে চেয়ারম্যানের যতসব অপকর্ম ও সম্পদের বিবরণী।
জানা যায়, ক্যশৈহ্লার দুর্নীতির ছোঁয়ায় জেলা পরিষদের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীও শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তার আমলে।
যেখানে এক সময় দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটত না সেই ক্যশৈহ্লার সম্পদের পাহাড় যেন আলাদীনের চেরাগকে হার মানাবে।
ক্যশৈহ্লার সম্পদের বিবরণী:
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বান্দরবান পৌরসভার উজানীপাড়াতে জমিসহ প্রায় ১৫ কোটি টাকা দামের ৫তলা ব্যয়বহুল ভবন, সদর উপজেলার রামজাদী নামক স্থানে জমিসহ প্রায় ২০ কোটি টাকা দামের বাড়ি নির্মাণ করেছে চীন থেকে রাজমিস্ত্রি এনে। বান্দরবান সদরের মেঘলা পর্যটন এলাকায়ও দুই কাগজে রয়েছে ২০ একর জমি। সদরের যৌথ খামার এলাকায় রয়েছে ১০ একর জমি। রুমা উপজেলার পুরাপাড়া চিম্বুক এলাকায় রয়েছে ১৫ একর জমি।
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে রয়েছে ৩শ একর জমি এবং আজিজনগর ইউনিয়নে চাম্বি মৌজাতেও রয়েছে ১৫০ একর জমি।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ভাল্লুক খাইয়া মৌজায় নামে-বেনামে রয়েছে প্রায় ১শ একর জমি। দলিল জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ক্রয় করে নামজারি করার চেষ্টা করছেন জমিগুলো। বন বিভাগ বাধা দেওয়ার পরেও ওই মৌজার দুর্নীতিবাজ হেডম্যান মংশৈপ্রুর সহযোগিতায় এসব জমি দখলে নিয়েছে ক্যশৈহ্লা।
এ ব্যাপারে মংশৈয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জারুলিয়া ছড়ি মৌজায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল্লাহর সহযোগিতায় উপজাতিদের প্রায় ২শ একর জমি জবরদখল করেছে ক্যশৈহ্লা। সেখানে জেলা পরিষদের প্রকল্প থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ ও দুই কোটি টাকা খরচ করে রাস্তাও নির্মাণ করেছেন।
তবে এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান শফিউল্লাহর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও উনি কল রিসিভ করেননি।
এলাকাবাসী জানান, জনমানবশূন্য এলাকায় কেন সরকারি এত টাকা খরচ করেছে সেটা আমাদের জানা নাই।
রেজু মৌজায় সাড়ে ৪ একর জমি বিভিন্নজন থেকে দলিলে ক্রয় করে সাধারণ মানুষের ২৫ একর জমি দখল করে নেয় ক্যশৈহ্লা।
সূত্রে জানা যায়, এই জমিতে বান্দরবান জেলা পরিষদের সরকারী প্রকল্প থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা বাজেট করে উন্নয়ন এবং বাগান করেন ক্যশৈহ্লা।
আলীকদমের নয়াপাড়া ইউনিয়নের পর্যটন এলাকা আলীর সুরঙ্গের পাশে প্রায় ১৫ একর জমি রয়েছে ক্যশৈহ্লার।
রোয়াংছড়ি উপজেলার লাফাইমুখ তার নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য ২০ কোটি টাকা খরচ করে ব্রিজ এবং রাস্তা নির্মাণ করেছেন জেলা পরিষদের প্রকল্প থেকে; যেখানে অন্য কোনো বসতি নাই বললেই চলে। জানা যায়, তার নিজের ব্যক্তিগত প্রার্থনার জন্য যে ক্যায়াং ঘর নির্মাণ করা হয়েছে তাও জেলা পরিষদের টাকায়।
অন্যদিকে সদর উপজেলার যৌথ খামার এলাকায় স্ত্রী নামেও তিনটি দলিলে জমি রয়েছে প্রায় ১৫ একর।
তাছাড়াও মিয়ানমারে গাড়ির শোরুম এবং মালেশিয়ায় জুতার ফ্যাক্টরিসহ অনেক ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। মালেশিয়ায় ব্যবসাগুলো দেখাশোনা করেন ক্যশৈহ্লার ২য় বউ রিংকী চৌধুরী এবং নাইক্ষ্যংছড়ির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল্লাহর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বান্দরবানের এক নেতা জানান, এসব সম্পদ সর্বনিম্ন বাজার দরও যদি ধরা হয় তাও হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
জমি ও প্লট বাণিজ্য:
জমি ও প্লটের লিজ বাণিজ্য ছিল ক্যশৈহ্লার অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস। সম্প্রতি বান্দরবান বহুমুখী সমবায় সমিতির দুটি প্লট অবৈধভাবে খাস দেখিয়ে রাতারাতি অন্যজনকে ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে লিজ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাছাড়াও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসের জায়গা ও লুম্বিনী লিমিটেডের জায়গা লিজ দেওয়ার সময়ও মোটা অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ক্যশৈহ্লার বিরুদ্ধে।
কেএনএফের মদদদাতা:
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবর রহমান এক বক্তব্যে বলেন, বান্দরবানের চলমান পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী ক্যশৈহ্লা। কারণ কেএনএফের প্রকৃত মদদদাতা হচ্ছেন তিনি। তার জন্য আজ বান্দরবান পর্যটন শিল্প ধ্বংসের পথে।
রাজাকারের ছেলে ক্যশৈহ্লা:
প্রকৃতপক্ষে ক্যশৈহ্লা হচ্ছে রাজাকারের ছেলে। তৎকালীন বান্দরবানের রাজাকারদের লিস্ট প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে তার বাবার নামও উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়াও প্রতিদিন সকাল ১০টায় মুজিব বাহিনীর কাছে হাজির হওয়া সাপেক্ষে তার বাবাকে মুক্তি দেওয়া গেল- এই মর্মে একটি পত্রও পাওয়া যায়।
ক্যশৈহ্লার নারী কেলেঙ্কারিও ছিল অনেক। নাম প্রকাশ না করা শর্তে জেলা পরিষদের এক কর্মচারী জানান, ১ম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে বান্দরবানের এক মুসলিম ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে বিয়ে করেন ক্যশৈহ্লা। তাছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিও কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক।
বিদ্যালয়ের টাকা আত্মসাৎ:
বান্দরবান ডনবস্কো উচ্চ বিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন ধরে সভাপতি ছিলেন ক্যশৈহ্লা। সভাপতি থাকাকালীন নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও বেসরকারিভাবে আরও একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেন ক্যশৈহ্লা এবং তার মাধ্যমে ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন বলে জানান বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে বান্দরবান জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ জানান, আমি যোগদান করেছি মাস ছয়েক হয়েছে মাত্র। তাই আমার এত কিছু জানা নাই।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে অনেক চেষ্টা করেও ক্যশৈহ্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মোবাইল নাম্বার, হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে এবং খুদেবার্তা দিয়েও কোনো প্রতি উত্তর পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ক্যশৈহ্লাসহ বান্দরবানের শতাধিক নেতাকর্মী পলাতক রয়েছেন।যুগান্তর
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com