ডেস্ক রির্পোট:- গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দলীয়ভাবে কঠোর অবস্থান নেওয়া হলেও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি এই তালিকায় ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিবসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার নামও এসেছে। এ ছাড়া ঢাকা জেলা ও মহানগর, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি,নেত্রকোনা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীরা। তবে অভিযুক্তরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে তাদের ঘায়েল করতে দলের ভেতর থেকে কেউ কেউ মিথ্যা অভিযোগ তুলছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে এবং রাজনৈতিক পালাবদলের সময় দলবদলের হিড়িক পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দলবদলে আদর্শিক কোনো বিষয় থাকে না। পুরোটাই ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ, আত্মরক্ষা ও রাজনীতিতে টিকে থাকা এবং নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপিতে আশ্রয় নিতে পারে—এমন আশঙ্কায় দলে যোগদান বন্ধের নোটিশ জারি করে বিএনপি।
গত ৮ আগস্ট বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ওয়ার্ড থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত কোনো স্তরেরই কমিটিতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে যোগদান করানো যাবে না। বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব স্তরের নেতাকর্মীর প্রতি দলের এই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া দেওয়া হয়েছে। এ ঘোষণার মাধ্যমে মূলত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনে নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘সমঝোতা’র মাধ্যমে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশীদারত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশকিছু নেতাকর্মী কালবেলার কাছে এমন অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ‘৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নামে বিভিন্ন স্থানে দখল ও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। মূলত একটি চক্রান্তকারী গোষ্ঠী দলের নাম ভাঙিয়ে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দখল, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। তিনি এসবকে বরদাশত করছেন না। এরই মধ্যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
নোয়াখালীর তৃণমূলের কয়েকজন নেতা অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির প্রভাবশালী একজন ভাইস চেয়ারম্যান আর্থিক সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগের ৯ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আশ্রিত নেতারা নোয়াখালীতেই অবস্থান করছেন। বিএনপির ওই ভাইস চেয়ারম্যান বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন বলে অভিযোগ। তার আশ্রয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আলম চৌধুরী সেলিম, সাধারণ সম্পাদক শহীদ উল্যাহ খান সোহেল, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম সামছুদ্দিন জেহান, হরিনারায়ণপুরের ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম, সোনাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা সিএনজি কামাল, মাইজদী বাজারের আওয়ামী ঘরানার ঠিকাদার জাবেদ, ইসমাইল ও দিদার।
স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের একাধিক নেতা অভিযোগ করে বলেন, নোয়াখালী বিএনপি অগোছালোভাবে চলছে। জেলা শহরে একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। বেশ আগে থেকেই তারা পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। এতে বৃহৎ একটি অংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভক্তি দূর করে দ্রুত জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনে দলের হাইকমান্ডের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা জানান, নোয়াখালী বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা; কিন্তু সেখানে জেলা বিএনপির কোনো দলীয় কার্যালয় নেই। আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয়দাতা বিএনপির ওই ভাইস চেয়ারম্যানের ইচ্ছাতেই মূলত নোয়াখালীতে বিএনপি চলছে। গঠনতান্ত্রিকভাবে তিন বছর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। জেলার ৬টি উপজেলায় বিএনপিতে হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে, যার প্রমাণ মেলে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের দুদিনের মাথায় সুবর্ণচর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক বেলাল হোসেন সুমন ও চাটখিল উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব বেলায়েত হোসন শামীমকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের একজনের সুবর্ণচরে সংখ্যালঘুর জায়গা দখলের চেষ্টা ও তার সঙ্গে অশোভন আচরণ এবং অন্যজনের বিরুদ্ধে একজন আওয়ামী লীগ নেতার পেট্রোল পাম্প দখলের অভিযোগ ওঠে। যারা দুজনই বিএনপির ওই ভাইস চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।
অভিযোগ উঠেছে, গত ৫ আগস্ট দুপুর থেকে নোয়াখালী সদর আসনের সাবেক এমপি একরামুল নোয়াখালীর কবিরহাটের নিজ বাড়িতে ছিলেন। জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার বিএসসি ও একরামুলের বাড়ি পাশাপাশি এলাকায়। বিএনপি নেতা হায়দার বিএসসির যোগসাজশে একরামুল করিম চৌধুরী ও তার ভাগ্নে কবিরহাট পৌরসভার মেয়র রায়হান নিজ বাড়িতে অবস্থান করেন। মেয়র রায়হানের স্ত্রীর ব্যবহৃত গাড়িটিও হায়দার বিএসসির তত্ত্বাবধানে থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে একপর্যায়ে গাড়িটি সরিয়ে ফেলা হয়। তারা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। এ ছাড়া নোয়াখালীর হাতিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় বিএনপির একজন সংস্কারপন্থি ও প্রভাবশালী নেতার যোগসাজশে তমরদ্দিঘাট দখলে নেন আলমগীর, নলচীরা ঘাট সাইফুল উকিল আর আজাদ। তারা বিএনপির ওই নেতার সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। তবে আলমগীর ছাড়া অন্যরা সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার বিএসসি কাছে দাবি করেন, এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা ও স্রেফ নাটক। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব অভিযোগ করছে। যেখানে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে হামলা-মামলা হয়েছে এবং জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। সেখানে দলের ভেতর থেকেই এ ধরনের অভিযোগ বিব্রতকর। স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারীদের গ্রেপ্তার কেন করছে না? উল্টো আমাদের দোষারোপ করা হচ্ছে!
এদিকে নেত্রকোনার পূর্বধলায় জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের তালুকদারের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন জায়গায় তার অনুগত লোকজন দিয়ে চাঁদাবাজি, টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা এবং তাদের দিয়ে দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দূরে সরানোর অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গতকালও পূর্বধলায় স্থানীয় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরেও অভিযোগ দেওয়া হবে বলে জানান তারা। কালবেলার হাতে আসা তথ্য বলছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ আরিফ খান জয়ের ঘনিষ্ঠ শেখ মোজাহিদুল ইসলাম লেলিন বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আহমদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ লিটনকেও তাহের তালুকদারের সঙ্গে বসে থাকতে দেখা গেছে।
জানতে চাওয়া হলে আবু তাহের তালুকদার বলেন, ‘লেলিন আমার দলের লোক। সে আমার সঙ্গেই থাকে। অতীতে দলীয় কর্মকাণ্ডে সে সক্রিয় ছিল। তবে লিটন নামে কাউকে চিনি না।’
তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় (নেত্রকোনা-৫) কোনো দখল, চাঁদাবাজি বা হামলার ঘটনা ঘটেনি।’
ময়মনসিংহের কয়েকটি থানায় বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে।কালবেলা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com