ডেস্ক রির্পোট:- পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে বিবৃতি দিলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা যেনো দিল্লি বসে আর কোনো বিবৃতি না দেন- সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ভারতের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে উপদেষ্টা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেন। এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, চীন ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। দিনভর সিরিজ ওই বৈঠকগুলো শেষে সন্ধ্যায় সেগুনবাগিচায় উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে উপদেষ্টা বলেন, ভারতে বসে শেখ হাসিনা বিবৃতি দিলে সম্পর্কের ক্ষতি হবে বলে আমরা হাইকমিশনারকে জানিয়েছি। আমি বলেছি- এটা সম্পর্ক উন্নয়নে মোটেও সহায়ক হবে না। এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের জবাব কী ছিল জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা আমাদের সরকারের অবস্থানটা স্পষ্ট করেছি। এটার জবাব তিনি (হাইকমিশনার) কীভাবে দেবেন? তিনি তো ডিসাইড করতে পারবেন না। তিনি এ নিয়ে কিছু বলতে পারেন না বলেই আমি মনে করি।
এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি যেটা পারেন, তার সদর দপ্তরে জানানো। আমি নিশ্চিত তিনি এটা সদর দপ্তরে জানাবেন। কোন প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা বিষয়টি বললেন? জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, এই আলোচনার প্রেক্ষাপটটা হলো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, যা বাংলাদেশ সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। আমরা চাই- তিনি ভারতে বসে যেন এটা না করেন। শেখ হাসিনার বিবৃতিকে আমরা কী হিসেবে দেখবো? এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমরা সরাসরি হোস্টাইল অ্যাক্ট হিসেবে বলছি না। কিন্তু এটা তো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অন্তরায়, সেটাই হাইকমিশনারকে বলার চেষ্টা করেছি। এটা কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বেলায়ও প্রয়োজ্য হবে? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে আমি কোনো কথা বলিনি। শেখ হাসিনার নামে মামলা হয়েছে, তাকে ফেরানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু ভাবছে কিনা? বা ভারতকে কিছু বলবে কিনা? এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বলবে। তারা যদি বলে ফেরত আনতে হবে, আমরা আনবো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ নিয়ে নিজে থেকে কিছু করার নেই। উপদেষ্টা বলেন, এ নিয়ে দু’টি মন্ত্রণালয় কাজ করে। একটি হলো স্বরাষ্ট্র, অন্যটি আইন। তারা যেভাবে পরামর্শ দেবে সেভাবেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে। ভারতের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে হাইকমিশনারকে কিছু বলেছেন কিনা? জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, আমি বলেছি- এখানে কিছু ঘটনা ঘটেছে সেটি আমরা খবর নিয়েছি, প্রধান উপদেষ্টা হিন্দু সমপ্রদায়সহ অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। আমরা চাই সবাই যেন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে, কারও ওপর হামলা সরকার সহ্য করবে না। দোষীদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। তাকেও (হাইকমিশনার) বলেছি- ভারতের গণমাধ্যম এটাকে অতিরঞ্জন করে খারাপ পরিবেশ তৈরি করছে, এটা ঠিক না। সীমান্ত নিয়ে কিছু বলেছেন কিনা? জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা বলেছি, কিছু সমস্যা আছে। এই একটি ইস্যু সীমান্ত হত্যা আমরা দুই পক্ষ চাইলে সমাধান করতে পারি। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন প্রচুর লিখেছি, সেটা আমার বিশ্বাস। এখনো বলবো, আমরা চাইলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে পারি। ভারতীয় দূতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, তিস্তা নদীতে যতটুকু পানি আছে, তার ন্যায্য হিস্যা চেয়েছি আমরা। আমি বলেছি, পানি যেটুকু আছে তা আমরা ভাগাভাগি করতে পারি। পানি কম আছে এটা ঠিক। যেটুকু আছে তার সুফল তো ভারত পাচ্ছে। আমরা একটুও কি পেতে পারি না?
অন্যান্য প্রসঙ্গ: যেসব বিদেশি বন্ধু দেখা করেছেন তাদের প্রায় সকলের সঙ্গেই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা সম্পর্কে অনেকে জানতে চেয়েছেন। আমরা তাদের জানিয়েছি, প্রয়োজনের চেয়ে একদিনও বেশি থাকবে না এই সরকার।
সরকারের সঙ্গে কাজ করার বার্তা বিদেশি কূটনীতিকদের: এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে চায় তার দেশ। দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগ ও স্বার্থকে গুরুত্ব দেয় দিল্লি। ওদিকে সরকারের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন বৃটিশ হাইকমিশনার ও সৌদি রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেয়া শুরু করেছে সৌদি দূতাবাস, জানান রাষ্ট্রদূত।
চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলে লাভ হবে দেশের: এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, যে সরকারই আসুক না কেন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সুসম্পর্ক থাকবে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে পরবর্তী প্রজন্ম বেনিফিটেড হবে। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক বরারবই ভালো। এটা স্মরণ করে আমি বলেছি, আমাদের পাশে থাকুন। উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীন হস্তক্ষেপ করবে না। চীন কঠোরভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পট পরিবর্তন এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও হস্তক্ষেপ করবে না চীন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় চীন সবসময় গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী চীন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সীমান্তে হত্যা বন্ধ, তিস্তা চুক্তি সইয়ের তাগিদ: এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি স্বতস্ত্র সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। এতে সীমান্তে হত্যা বন্ধ, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি বিষয়গুলো উত্থাপন করেন। বিজ্ঞপ্তি মতে, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া অত্যন্ত অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে। ভারত থেকে আসা এ ধরনের বক্তব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করার জন্য সহায়ক নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায়। তিনি আগামীতে আরও গণকেন্দ্রিক সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেন। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির সমাপ্তি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জোর দেন। ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে তার নতুন দায়িত্বের জন্য অভিনন্দন জানান। তিনি প্রধান উপদেষ্টার প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শুভেচ্ছার কথা উল্লেখ করেন এবং উভয় দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য ভারত সরকারের গভীর আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। তৌহিদ হোসেন হাইকমিশনারের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন সমপ্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সরকার সব ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা বা ভয়ভীতি সহ্য করা হবে না। পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে হাইকমিশনারকে অবহিত করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং অর্থনীতিকে ট্র্যাকে নিয়ে আসা। মিস্টার হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে উত্তরণ নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com