ডেস্ক রির্পোট:- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়কে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
রাজধানীতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও বিনোদনজগতের তারকারা গতকাল সড়কে নেমেছিলেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনজীবীরাও বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচিতে লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। মিছিল-স্লোগানে উত্তাল হয়েছে হবিগঞ্জ। কিশোরগঞ্জে সড়ক-দেয়াল হয়েছে রক্তরাঙা। হবিগঞ্জ, গাইবান্ধা ও নোয়াখালীতে সড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সড়কে নেমেছিলেন শিক্ষকেরাও। সিলেটে পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়েছে।
ঢাকার রাজপথে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও শোবিজ জগতের তারকা ও কলাকুশলীরা গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটে দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী সমাজের ব্যানারে সমাবেশ করেন। শিল্পীরা বলেন, সরকার যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করেছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
কর্মসূচিতে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, ‘বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ঘরে বসে থাকার মতো অবস্থায় নেই আমি। আমরা শান্তি চাই। রক্ত দেখতে চাই না।’ অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, ‘রাষ্ট্রব্যবস্থার ছবি এটা হতে পারে না। এসব অন্যায়ের সুষ্ঠু তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হোক এবং সেই বিচারের প্রকাশ্য প্রয়োগ আমরা দেখতে চাই।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন অভিনেতা মামুনুর রশীদ, নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষা, নির্মাতা আকরাম খান, পিপলু আর খান, শিল্পী ঋতু সাত্তার, আরমিন মুসা, নির্মাতা আশফাক নিপুণ, সুকর্ণ শাহেদ, রেদওয়ান রনি, নুহাশ হুমায়ূন, ইরেশ যাকের, সিয়াম আহমেদ, জাকিয়া বারী মম, সাবিলা নূর, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা প্রমুখ।
শাহবাগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মানববন্ধন থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সব হত্যার বিচার দ্রুত করার দাবি জানানো হয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে অংশ নেন দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ফেডারেশনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আহ্কাম উল্লাহ্, সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, নৃত্যশিল্পী সংস্থার সহসভাপতি ড. নিগার সুলতানা, যাত্রাশিল্পী সংসদের সভাপতি মিলন কান্তি দে, চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রফিকুল ইসলাম, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল চন্দন রেজা, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান প্রমুখ।
এদিকে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। গতকাল মিন্টো রোডে ডিএমপির গোয়েন্দা কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানান বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ সময় অর্থনীতিবিদ ও জননীতি বিশ্লেষক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে আটক ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ বিনা বিচারে আটক ও আইনানুগ ব্যবস্থা ছাড়া আটকদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এটা হচ্ছে আমাদের প্রধান দাবি।’ মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।
এদিকে সিএমএম কোর্ট এলাকায় প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মৌন-বিক্ষোভ মিছিল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ডাকা সমাবেশে যোগ দেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষকদের সঙ্গে মিছিল করে আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ও নীরবতা পালন করেন তাঁরা। সন্ধ্যায় রামপুরার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন ও প্রতিবাদী গান পরিবেশন করে শহীদদের স্মরণ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দুপুরে প্রতিবাদী গানের মিছিল করেছেন। এতে সংহতি জানিয়ে অংশ নেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ১২ জন শিক্ষকও।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে পুলিশ। এ সময় সাঈদুর মিয়া (১৭) নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের ধাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন সুরমা আবাসিক এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখানে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল করেছেন শিক্ষকেরা। খুলনায় দুপুরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে মানববন্ধন করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও মৌন মিছিল করেছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মানববন্ধনে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসতে চাইলে সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় লোকজন বাধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শেষ পর্যন্ত ছয়জন শিক্ষক কর্মসূচির স্থানে আসতে পারেন এবং ওই ছয়জনই মানববন্ধন করেছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের বাধায় ‘ছাত্র-শিক্ষক সংহতি সমাবেশ’ পণ্ড হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভসহ ১২ শিক্ষার্থীকে আটক করে বন্দর থানায় নিয়ে আসে। পরে শিক্ষকেরা গিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন।
এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহত, দেশব্যাপী নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি
নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া শহীদ মিনার এবং বালুর মাঠ সড়কে সন্ধ্যায় আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচিতে বাধা ও লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু সড়কে মিছিল বের করে।
চাঁদপুরে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলায় অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বিকেল ৩টার দিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কের ষোলঘর এলাকায় জড়ো হওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে তাদের একাধিকবার ধাওয়া করে ছাত্রলীগ। তাদের নেতৃত্ব দেন স্থানীয় কাউন্সিলর কবির চৌধুরী। ধাওয়া খেয়ে শিক্ষার্থীরা শহরের বাসস্ট্যান্ড ফয়সাল শপিং কমপ্লেক্সের সামনে অবস্থান নেয়। বিকেল ৫টার দিকে ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতা-কর্মী পুলিশের সামনেই অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় কয়েকজন ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হবিগঞ্জে দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা শহরের টাউন হলের সামনে স্টুডেন্টস অব হবিগঞ্জ ব্যানারে অবস্থান নেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা তাঁরা শহরের প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাখেন। পরে পুরো শহরে মিছিল হয়।
পঞ্চগড়ে দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। কিশোরগঞ্জে জেলা শহরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের দেয়াল ও সড়ক রক্তলাল অক্ষরে রাঙিয়ে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি পালন করেছেন। গাইবান্ধায় বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। গাইবান্ধা বার অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন আইনজীবীও আন্দোলনে যোগ দেন। বৃষ্টি উপেক্ষা করে নোয়াখালীতে বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জেলা শহর মাইজদীর সুপার মার্কেট-সংলগ্ন প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। বগুড়ায় গানে গানে ও দেয়াললিখনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com