ডেস্ক রিপোট:- ‘দুইটা দিন ভয়াবহ কেটেছে। এতটাই ভয়াবহ যে, বলে বোঝাতে পারবো না। পাঁচদিন পর আজ দোকান খুললাম। এখনো মনে হচ্ছে গুলির শব্দ কানে বাজছে।’ কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ডাকা শাটডাউন কর্মসূচির দিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকার ব্যবসায়ী হারুন-অর-রশিদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ও মৃত্যুর ঘটনায় গত ১৮ই জুলাই দেশব্যাপী শাটডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সে ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন উত্তরা এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সেই কর্মসূচিতে নেমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমনের মুখে পড়ে আহত ও নিহত হয়েছেন অনেকে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮ই জুলাই উত্তরায় যারা বিক্ষোভে নামেন তারা সবাই ছিলেন শিক্ষার্থী। আন্দোলনে হামলার শিকার আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে উত্তরার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে।
১৮ থেকে ২০শে জুলাই পর্যন্ত থমথমে পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে উত্তরা আজমপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, সকাল থেকেই ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে রাখে। তারা সেøাগান দিচ্ছিলো। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের সংখ্যাও অনেক হয়।
রাজলক্ষ্মী এলাকা থেকে আজমপুর পার হয়ে হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী দেখেছি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত পুলিশ কিছু বলেনি। ১২টার পরই শুরু হয় টিয়ারশেল মারা। এরমধ্যে গুলিও হয়। হাজার হাজার ছাত্র তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আবার জড়ো হয়। দুই পক্ষ থেকে ইটপাটকেল মারা শুরু হতে থাকে। তখন শুধু রক্তাক্ত অনেক ছাত্রকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখেছি।
আনিসুল হক নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমার স্ত্রীকে অফিসে পৌঁছে দিতে সকালেই জসীম উদ্দিন এলাকায় আসি। তখনই দেখতে পাই রাজলক্ষ্মী থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। বাইকটা রাজলক্ষ্মীর একটি ভবনের ভেতর রেখে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিক্ষোভ দেখতে থাকি। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ অ্যাকশন শুরু করে। টিয়ারশেল ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। তখন আমি নিরাপদ স্থানে গিয়ে দাঁড়াই। এ সময় অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। আমার সামনে দিয়েই অন্তত ৫০ জনকে নিয়ে যেতে দেখেছি। আমি আরও দেখার জন্য উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে যাই। সেখানে আরও ভয়াবহ অবস্থা দেখতে পাই। শুধু আহত শিক্ষার্থীর ঢল। কারও চোখে আঘাত লাগে, কারও মাথায়। সবাই রক্তাক্ত। আমি এমন দৃশ্য দেখিনি কখনো।
সূত্রমতে, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসেন। এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক মেজর (অব.) মো. হাফিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, সংঘর্ষে হাসপাতালে আসা সব আহত ও নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ও বিবরণ (ডকুমেন্টেশন) সঠিকভাবে রাখা সম্ভব হয়নি।
চার দিনে এই হাসপাতালে ২৬৩ জন আহত ব্যক্তি এবং ১১টি মৃতদেহ এসেছিল। এরমধ্যে ১৮ই জুলাই ১৭৯ জন আহত ব্যক্তি ও ছয়টি মৃতদেহ, ১৯শে জুলাই ৫৯ জন আহত ব্যক্তি ও পাঁচটি মৃতদেহ, ২০শে জুলাই ২৩ জন আহত ব্যক্তি এবং ২১শে জুলাই দু’জন আহত ব্যক্তি হাসপাতালে আসেন।
উত্তরা আধুনিকের সাবেক এক কর্মী ছিলেন সেদিনের বেশির ভাগ সময়ের সাক্ষী। তিনি বলেন, আমি এখানে ২৩ বছর ধরে বসবাস করি। সেদিনের ঘটনা আমার দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ। এত মানুষ কখনো আহত হতে দেখিনি। বৃহস্পতিবার প্রতি ঘণ্টায় মনে হয় একশ’র উপরে ছাত্র উত্তরা আধুনিকে চিকিৎসা নিতে আসে। হাসপাতালে দাঁড়ানোর জায়গাও ছিল না। আমিও অনেক ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।
এদিকে উত্তরার আজমপুর এলাকায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮ ও ১৯শে জুলাই দু’দিনে হাসপাতালটিতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। যারা সেখানে চিকিৎসা নিতে আসেন বেশির ভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী। অবশ্য ১৯শে জুলাই শিক্ষার্থী কম ছিল বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, ১৮ তারিখ তো দম ফেলার সুযোগ পাইনি। এত রোগী সেবা দিতে গিয়ে আমাদের সবার অবস্থা খারাপ ছিল। ওইদিন যারা হাসপাতালে আসেন সবাই স্টুডেন্ট। পরদিন স্টুডেন্ট তেমন ছিল না। তবে সবাই ইটের আঘাত ও গুলিবিদ্ধ ছিল। হাসপাতালটির পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, আড়াইশ’র বেশি আহতকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আটটি মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
উত্তরা ১১নং সেক্টরে ১৮ই জুলাই অফিসের কাজে এসেছিলেন টঙ্গী এলাকার চাকরিজীবী শাওন। তিনি জমজম টাওয়ারের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে শাওন বলেন, আমি অফিসিয়াল একটা কাজে জমজমে আসি। এমন সময় পেছন থেকে আমার বাহুতে একটি গুলি লাগে। আমার মনে হয়েছে এটা উপর থেকে করা হয়েছে। কারণ গুলিটা এমনভাবে পড়েছে সেটা নিচ থেকে করা হয়েছে বলে মনে হয়নি। আমার বাহুতে হাত দিয়ে দেখি প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় শিন শিন জাপান হাসপাতালে নিয়ে যায় আশপাশের মানুষ। চিকিৎসা শেষে আমি বাড়ি ফিরে যাই। আজ আবার ড্রেসিংয়ের ডেট ছিল। তাই এসেছি।
উত্তরার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯শে জুলাই শুক্রবার দিনভর আন্দোলন চলছিল। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে গুলির ঘটনাও ঘটে কয়েকবার। এরমধ্যেই বিকাল চারটার দিকে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দলবল নিয়ে আন্দোলনকারীদের কাছে আসেন। তখন দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তাদের দেখে আন্দোলনকারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একপর্যায়ে জাহাঙ্গীরকে মারধর করেন। তাকে বাঁচাতে আসলে পিটুনির শিকার হন পিএস রানা মোল্লা। মারধরে তার মৃত্যু হয়।
ওদিকে সংঘাতের ঘটনায় ওই এলাকার হাসপাতালগুলোতেও ছিল অবর্ণনীয় চিত্র। ওই এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) কমান্ডার (অব.) মো. নাজমুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ১৮ ও ১৯শে জুলাই দুই দিনে একশ’র মতো আহত রোগীকে তারা চিকিৎসা দিয়েছেন। দুই দিনে নিহত পাঁচজনকে এই হাসপাতালে আনা হয়। তাদের তিনজন ছিলেন শিক্ষার্থী।
উত্তরার আজমপুরের হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতালেও আহত কয়েকজনের চিকিৎসা দেয়া হয়। সেক্টর-১১ এর গরিব-ই-নওয়াজ এভিনিউয়ের লুবানা জেনারেল হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারেও আহত অনেকে এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে।
উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে বেসরকারি সৈয়দ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংঘর্ষের প্রথম দুই দিনে ১৭৫ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিতে যান। তাদের অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। সেখানে দুই জনের মৃতদেহ নেয়া হয়েছিল। তবে হাসপাতালে মৃতদেহ রাখা হয়নি।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com