ডেস্ক রির্পোট:- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাড়ানো হয়েছিল ঋণের সুদহার। সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার উঠেছে প্রায় ১৫ শতাংশে। যদিও এর সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরজুড়ে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও কমেনি মূল্যস্ফীতি। উল্টো নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে বহু গুণ। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার আরো বাড়ানোর পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে সুদহার বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সভা গতকাল অনুষ্ঠিত হয়। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ওই সভায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মুদ্রানীতির খসড়া পাস হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গত দুই অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিও হবে ‘সতর্ক’ ও ‘সংকুলানমুখী’। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে নিয়ন্ত্রণ করা হবে অর্থের প্রবাহ। এজন্য নীতি সুদহার (রেপো রেট) আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে নীতি সুদহার বাড়তে পারে ৫০ বেসিস পয়েন্ট। তবে এটি কার্যকর হতে পারে দুই ধাপে। বর্তমানে নীতি সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করে সেটিই নীতি সুদহার। এ সুদহার বাড়লে ব্যাংক ঋণের সুদও বাড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, আগামীকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে নতুন মুদ্রানীতি পাস হবে। পরে ১৮ জুলাই তা ঘোষণা করা হবে। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গভর্নরের মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রথা চালু থাকলেও এবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে। মূলত সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের ইস্যুতে মতবিরোধের জেরে প্রচলিত প্রথা থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে গত দুই অর্থবছরজুড়েই ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। যদিও সে হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তার জন্য ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমাও তুলে নেয়া হয়। একই সঙ্গে দফায় দফায় বাড়ানো হয় নীতি সুদহার। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছরের মধ্যেই ঋণের সুদহার ৯ থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশে ঠেকে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান হয়নি। সর্বশেষ জুনে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, টানা ১৬ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা যদিও বলছেন, বিবিএসের তথ্যের চেয়ে দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো অনেক বেশি। প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে হিসাবায়ন না করায় মূলত এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রতিবেশী প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কমে এসেছে। এক বছর ধরে ভারতের মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে রয়েছে। সর্বশেষ জুনেও প্রতিবেশী দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩১ শতাংশের বেশি। চলতি বছরের জুনে এসে সে হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫২ শতাংশে উঠলেও বর্তমানে তা ১ শতাংশেরও কম। চলতি বছরের মে মাসে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ছিল দশমিক ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজারে পণ্যের দাম আরো বাড়ছে। আবার ব্যবসায়িক মন্দা ও সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুটিই বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হওয়ার মুখে। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার বাড়লে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সুদহার এমনিতেই অনেক বেড়ে গেছে। আশা করছি, ঋণের সুদ আর বাড়বে না। গভর্নরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলো এখন সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। কোনো ব্যাংক এর চেয়ে বেশি সুদ নিলে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কাছে অভিযোগ করব।’
প্রায় দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকট চলছে। ব্যাংকগুলো উচ্চ হারে সুদ দিয়েও আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। সংকট তীব্র হওয়ায় দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংক তারল্যের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়েও কিছু ব্যাংককে নগদ অর্থের জোগান দিচ্ছে। আবার সরকারও ঘাটতি বাজেট পূরণে পুরোপুরি ব্যাংক ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত ঋণের জোগান নিশ্চিত করাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ১০ শতাংশ। মে মাস পর্যন্ত এ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্জিত হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে। যদিও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বেসরকারি খাতে যে ঋণ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে, সেটি নতুন ঋণ নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ও অনাদায়ী সুদ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবেই বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি বাড়ছে। দেশে নতুন বিনিয়োগ বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। বড় উদ্যোক্তারাও নিজেদের ব্যবসা ছোট করে আনছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অপরিবর্তিত রাখার সম্ভাবনাই বেশি।
জানতে চাইলে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। মুদ্রানীতিতে সুদহার আরো বাড়ানো হলে সেটি ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক বেশি কষ্টকর হবে। সাধারণ মানুষের স্বার্থে মূল্যস্ফীতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার ব্যবসায়ীদেরও বাঁচতে দিতে হবে। এ দুটির সমন্বয় না হলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করেছে। এ ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ। যদিও অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে ঋণের জোগান দিতে গিয়ে বেসরকারি খাতের আরো বেশি ঋণবঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার উঠেছে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশে। ব্যাংকগুলো এখন সরকারকে ঋণ দেয়াকেই বেশি লাভজনক ও নিরাপদ মনে করছে। চলতি অর্থবছরে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার আরো বাড়বে বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণাই বেশি প্রত্যাশিত বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতে আমানতের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। কিছু ব্যাংক সাড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে। কিন্তু আমরা ১৩-১৪ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ দিতে পারছি না। এ পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বাড়বে, সেটিই প্রত্যাশিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার আরো বাড়ানোর জন্য অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) একই কথা বলছে।’
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বৃদ্ধিই একমাত্র উপায় নয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও অনেক দায়দায়িত্ব রয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় তদারকির যথেষ্ট ঘাটতি আছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ যেন ঠিক থাকে সেটিও নিশ্চিত করা দরকার।’বণিক বার্তা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com