শহীদুল্লাহ ফরায়জী:- ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা—মুক্তিবাহিনীর সকল সদস্যের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা করেন। জাতীয় মিলিশিয়া গঠন সম্পর্কে সরকারি ঘোষণায় বলা হয়— ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করেন যে, মুক্তিবাহিনী প্রতিভা সমূহের এক অপূর্ব ভাণ্ডার, যাহারা দেশ পুনর্গঠন ও ইহার অর্থনৈতিক কাঠামো পুনরুদ্ধার এবং যতো শীঘ্র সম্ভব উন্নতি লাভের জন্য এক নতুননেতৃত্ব দান করতে সক্ষম। অনতিবিলম্বে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠন করা হইবে এবং তালিকাভুক্ত হোক বা না হোক সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাকে ইহার আওতায় আনা হইবে।’ (সিমিন হোসেন রিমি সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ: আলোকের অনন্তধারা) কিন্তু আর্থ-সামাজিক মৌল রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের প্রস্তাবটি অচিরেই পরিত্যক্ত হয়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার —এই ত্রয়ী মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বীর জনগণ সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং বীর শহীদগণ প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো। কিন্তু জনগণ কী আকাঙ্ক্ষায় বা উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পত্তন করেছিলেন সেটা বিবেচনায় না নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা অক্ষত রেখেই ‘৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ফলে কাঙ্খিত রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব হয়নি। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন ও সংবিধান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়টি পর্যালোচনা করা জরুরি।
বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সারাদেশে ছাত্রজাগরণ ঘটেছে। বৈষম্যের ঠাঁই—হবে না বাংলায়, এই অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতিতে একটি বিশাল ছাত্রপ্রজন্ম নৈতিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে রাজপথ দখলে নিয়েছে। ভয়-ভীতি প্রদর্শন করলে আন্দোলন স্তব্ধ হবে না বরং ন্যায় সঙ্গত দাবি পূরণ করাই হবে যথার্থ পদক্ষেপ।
আমাদের সংবিধানে ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনীতি বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়:-
ক) অন্ন, বস্ত্র ,আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা-সহ জীবনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।
খ) কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার।
গ) যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার।
ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃ-পিতৃহীনতা কিংবা অনুরুপ পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
গত ৫৩ বছরে কোনো সরকার এই মৌলিক দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করেনি। অথচ জনগণ মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সশস্ত্রযুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ না বলে মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো।
যেকোনো নাগরিক বা শিক্ষিত ছাত্র-যুবকের কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন আমরা শুনতে পাচ্ছি উন্নয়নের মহাসড়কে আমাদের অবস্থান। কিন্তু
সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা অনগ্রসর অংশের জন্য সংরক্ষিত রাখা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর যতো জনগোষ্ঠী অনগ্রসর ছিলো গত ৫৩ বছরে তা কি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে? যে দেশে ৫৬ শতাংশ অনগ্রসর গোষ্ঠী সে রাষ্ট্র উন্নয়নের দাবিদার কী ক’রে হয়? এসব মৌলিক প্রশ্ন সর্বদা সর্বাগ্রে উত্থাপন করতে হবে।
সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা প্রশ্নে সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—’প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ কিন্তু ২৯ (৩) এর (ক) বলা হয়েছে— নাগরিকের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।’
যেহেতু রাষ্ট্র বৈষম্যহীন অবস্থায় উন্নীত হয় নাই তাই সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় কতিপয় বিষয়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের বর্ণনায় অনগ্রসর সম্প্রদায় বা শ্রেণী হলো তারা, যারা সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। চরম অবহেলিত, বিছিন্ন, উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে এরা পরিচিত। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে—জেলে, সন্যাসী, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা, হাজাম, নিকারী, পাটনী, কাওড়া, তেলী, পাটিকর, সুইপার, মেথর বা ধাঙ্গর, ডোমার, ডোম, রাউত ও নিম্নশ্রেণীর পেশার জনগোষ্ঠী।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ মতে বাংলাদেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৪,৯০,০০০ জন। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন তথা এ জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। উন্নয়নের নামে হাজার-হাজার কোটি টাকার অপচয়, হাজার-হাজার কোটি টাকা পাচারের দেশে প্রায় ১৫ লক্ষ জনগোষ্ঠী যুগের পর যুগ অনগ্রসর, অবহেলিত বা উপেক্ষিত থেকে যাবে, এটা সমগ্র জাতির জন্য লজ্জাজনক। রাষ্ট্র এই অনগ্রসর অংশসমূহকে চিহ্নিত ক’রে অগ্রসরমান সমাজের ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য
গত ৫৩ বছরে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিতে পেরেছে ? অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা কত? এই জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করনের জন্য রাষ্ট্র কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? অনগ্রসর অংশকে সমতার অধিকারী করার কী প্রক্রিয়া সরকার গ্রহণ করেছে? সরকারের উন্নয়ন পদক্ষেপের ফলে ক্রমাগত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী সীমিত হয়ে আসছে কি না বা প্রজাতন্ত্রের কর্ম লাভের উপযোগী হয়েছে কি না তা নির্ধারণের কোনো প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের নেই।
সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা সংরক্ষণে কী পরিমাণ অনগ্রসর গোষ্ঠী সুযোগের সমতা পাওয়ার অধিকারী হয়েছে তার কোনো তথ্য সরকার উপস্থাপন করে না।
আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছে ২৭) ও আইনে আশ্রয় লাভে সকল নাগরিকের সমান অধিকার। আইনের সমতা ও আইনের আশ্রয় লাভ করা জনগণের নিরঙ্কুশ অধিকার। যা ৩১ অনুচ্ছেদ নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু রাষ্ট্র যদি সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে, তাহলে অনগ্রসর গোষ্ঠী কী ক’রে সুযোগের সমতা লাভের অধিকারী হবে? অনগ্রসর অংশকে অগ্রসরমান সমাজে রূপান্তরের প্রক্রিয়া এবং পরিকল্পনা অসাধ্য কিছু নয়। লক্ষ্য ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ক’রে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা অবশ্যই দূরীভূত করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রে নাগরিকের দু’টি শ্রেণি সৃষ্টি হতে পারে না। অগ্রসরমান অংশ প্রথম শ্রেণীর নাগরিক আর অনগ্রসর অংশ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক—এই রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।
মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্র যখন বিপজ্জনক বৈষম্যে উপনীত হয়েছে তখন সরকার অনবরত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নের বুলি আউড়াচ্ছে। চরম বৈষম্য রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে ক’রে দিচ্ছে অথচ সরকার তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ছাত্ররা যখন ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের অর্থাৎ বাংলাদেশের সকল সরকারি চাকুরিতে কোটার সংখ্যা কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ ক’রে, সাংবিধানিক নির্দেশ মোতাবেক কোটা পদ্ধতির দাবি নিষ্পন্ন করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গ’ড়ে তুললো তখন ইচ্ছাকৃতভাবে সরকার নিয়োগ পদ্ধতিতে কোটাব্যবস্থা বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়। সরকারের ঐ প্রজ্ঞাপন ছিলো সংবিধানের শর্ত লঙ্ঘন ও নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। সরকার তখন জানত তাদের এই প্রজ্ঞাপন আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে এবং বাতিল হবে। জেনেশুনে কোটা পদ্ধতি নিয়ে জটিলতা তৈরি করা সরকারের কর্তব্য হতে পারে না।
মুক্তিযোদ্ধাগণ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের সম্মান-মর্যাদা এবং সামাজিক নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই বৈষম্য প্রদর্শন করবে না—এ অঙ্গীকারেই জীবন-মরণ পণ ক’রে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধাগণ । রাষ্ট্রকে বৈষম্যহীন করাই তাঁদের স্বপ্ন। জনগণ একক এবং অবিভাজ্য। জনগণের সাথে
মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো বিভাজন কোনোক্রমেই কাম্য নয়। সুতরাং কোটা সংস্কারের প্রশ্নে সরকারকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ছাত্রদের বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ছাত্রদের নবতর নৈতিক জাগরণ ঐতিহাসিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অতএব কোটা সংস্কারের প্রশ্নে:-
১) মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে শহীদ পরিবার বা যুদ্ধাহত পরিবারের শুধুমাত্র সন্তান অন্তর্ভুক্তকরণ।
২) অনগ্রসর অংশ কারা তা চিহ্নিতকরণ ও সুনির্দিষ্টকরণ ক’রে কোটা নির্ধারণ, যা
সর্বোচ্চ ৫ শতাংশে সীমিত করে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ সৃষ্টি করা।
সমাজ ও রাষ্ট্র যতো সমৃদ্ধ হবে, অনগ্রসর অংশ যতো সীমিত হবে, ততোই কোটা পদ্ধতি সীমিত হবে এবং এক পর্যায়ে এই পদ্ধতি বিলোপ হবে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই
একক ও মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা
অনুসরণের উপযোগী-বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে, যা হবে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’-এর কাঙ্খিত বাংলাদেশ।
সৎ ও মেধার ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ এবং সীমিত কোটা পদ্ধতির আইনি কাঠামো প্রণয়ন হলেই সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক চলমান কোটা সংস্কারের দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com