ডেস্ক রির্পোট:- এবার ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হয় ১৬ জুন রোববার। এর ঠিক আগের দুই দিন ১৪ ও ১৫ জুন (শুক্র ও শনিবার) ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে সচিবালয়ে কর্মরত বেশির ভাগ কর্মকর্তাই ১৪ জুন বা তার আগেই নির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি দরপত্রের ব্যয় মঞ্জুরি দিতে শুক্র ও শনিবার কোনো কোনো কর্মকর্তাকে অফিস করতে হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ঈদের আগে শুক্রবার অফিসে থেকে ব্যয় মঞ্জুরির নথি প্রস্তুত করান। পরদিন শনিবার সেই নথি অনুমোদনও করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে এসব জানা গেছে।
সূত্রমতে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ১৫ জুন শনিবার ওই নথি অনুমোদন করেন। তবে পরে তা আবার স্থগিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ফোনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, জুন মাসের শেষের দিকে কেনাকাটা বা দরপত্রসংক্রান্ত কোনো নথি অনুমোদন না করার নির্দেশনা ছিল। ওই নথিটিও ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে সচিবের দপ্তরে গেলে তিনি ফেরত পাঠান। কিন্তু রাতে ফোন করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শুক্রবারেই নথিটি প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন। সচিব নিজেও সেদিন অফিস করেন। পরের দিন শনিবার মন্ত্রী নথিটি অনুমোদন করেন। হঠাৎ কী কারণে নথিটির গুরুত্ব বেড়ে গেল এবং তড়িঘড়ি করে ছুটিতে সেটি প্রস্তুত ও অনুমোদন করা হলো, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘টেন্ডারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ওসব নথি যাচাই-বাছাই করে ছুটির দিনে ফাইল প্রস্তুত করিয়েছি। এমনকি শনিবার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী এতে অনুমোদন দেন। এরপর মন্ত্রী কার্যক্রম স্থগিত করতে বলেছেন কি না সেটি আমার জানা নেই।’
স্বাস্থ্যসেবা সচিব আরও বলেন, এমনিতেই বরাদ্দের টাকা খরচ করতে না পারার দুর্নাম রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। তা ছাড়া এই প্রকল্পের অবকাঠামো প্রায় সম্পন্ন, তাই যন্ত্রপাতি কেনা জরুরি ছিল।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা সিদ্দিকা মাহতাব ১৪ জুন শুক্রবার ওই নথিতে সই করেন। নথিতে উল্লেখ আছে, দেশের আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক ইমেজিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অধীনে সরকারি অর্থায়নে জিডি-৩ (রেডিওলজি, এন্ডোস্কপি অ্যান্ড পিএসিএস+আরআইএস ইকুইপমেন্ট) সংগ্রহে (৪৯ কোটি ৫২ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫৫ টাকার) দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ, চুক্তিপত্র সম্পাদন ও ব্যয় মঞ্জুরি দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করা হলো। সেখানে ১২টি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটি শর্ত হলো—এই অর্থ ব্যয়ে ভবিষ্যতে ত্রুটি বা অনিয়ম হলে বিল পরিশোধকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন (কম্পোনেন্ট-২ দেশের আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক ইমেজিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কিনতে তিনটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর দুটি (জিডি১ অ্যান্ড জিডি২) প্যাকেজ জাইকার অর্থায়নে এবং একটি (জিডি৩) প্যাকেজ সরকারি অর্থায়নে কেনা হবে। জাইকার অর্থায়নের প্যাকেজ দুটি কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম ও ত্রুটি পাওয়ায় দরপত্র জমার এক বছর পরও কেনাকাটা সম্পন্ন হয়নি। দরপত্র দুটিতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও একটিকে রেসপনসিভ দেখিয়ে জাইকার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তবে দরপত্রটির মূল্যায়ন ত্রুটিমুক্তভাবে না পাওয়ায় জাইকা ঢাকা অফিস দরপত্রগুলো প্রথম থেকে পুনর্মূল্যায়নের জন্য নির্দেশনা দেয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি। একইভাবে সরকারি অর্থায়নের প্যাকেজটিও একটি নির্দিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিতে চারবার দরপত্র ডাকা হয়। সঠিকভাবে যাতে যাচাই-বাছাই না করা যায়, সে জন্য অর্থবছরের শেষ প্রান্তে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আর ছুটির দিনে তড়িঘড়ি করে সেটি অনুমোদন করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখার একটি সূত্রে জানা যায়, দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা যন্ত্রগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য যান্ত্রিক সক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে বাধ্যতামূলকভাবে সিএমসি (কমপ্রিহেনসিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট) করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে উল্লিখিত দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিএমসি প্রস্তাব সঠিকভাবে দাখিল করেনি। এতে ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে সরকারের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দরপত্রটি সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে মতামত দিলেও একটি মহল সময়স্বল্পতাসহ বিভিন্ন অজুহাতে তড়িঘড়ি করে এক দিনের মধ্যে নথিটি প্রস্তুত করায়।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দুটি প্যাকেজের আওতায় সাতটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কেনাকাটার অনুমোদন এক বছরেও সম্ভব হয়নি। অথচ তৃতীয় প্যাকেজের আওতায় মাত্র একটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ত্রুটিপূর্ণ কেনাকাটার প্রক্রিয়াটি অনুমোদনে তড়িঘড়ি করা হয়েছে। এতে পুরো ক্রয় প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আন্তর্জাতিক ক্রয়চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ার নীতিমালা অনুসারে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দরপত্র প্রস্তাব গৃহীত হলে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ওই দরের ব্যয় মঞ্জুরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। মন্ত্রণালয় ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেবে। ব্যয় মঞ্জুরি পাওয়ার পর ক্রয়কারী দরদাতাকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) জারি করবে। সেই এনওএ সাত কর্মদিবসের মধ্যে দরদাতা গ্রহণ করে ১৪ দিনের মধ্যে নিরাপত্তা জামানত জমা দেবে এবং ২৮ দিনের মধ্যে ক্রয়চুক্তি সম্পাদন করবে। ক্রয়কারী জামানত হিসেবে জমা করা ব্যাংক গ্যারান্টি বা পে-অর্ডার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে যাচাইয়ের পত্র জারি করবে এবং যাচাই সম্পন্ন হলে দরদাতাকে খসড়া চুক্তিনামা দেবে। চুক্তি স্বাক্ষর কার্যক্রম সম্পন্ন হলে দাখিল করা দরপত্র নথি ও দরপত্রের বিভিন্ন শর্ত অন্তর্ভুক্ত করে চুক্তিপত্র বই বানিয়ে বাজেট কাটার জন্য এজিবিতে পাঠাবে। এজিবি থেকে বাজেট কর্তন হলে এলসি খোলার আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। কিন্তু আলোচিত দরপত্রের নথি অনুমোদনের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য সিএমসি প্রস্তাব দরপত্রের সঙ্গে দাখিল করেনি দরদাতা প্রতিষ্ঠান।
ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, সরকারি ক্রয় বিধিমালায় (পিপিআর) এই সময়ের মধ্যে এ ধরনের কাজ করার কোনো বিধান নেই। বছর শেষে এমন কাজ করার উদ্দেশ্য হলো অর্থ তছরুপ করা।
সামগ্রিক বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে সরকারি ক্রয় বিধিমালা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। তাই পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। অনিয়মের মাধ্যমে দুর্নীতির উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে নথি উপস্থাপন ও অনুমোদন করা হয়েছে। দুটি পক্ষ আর্থিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এখানে নথি প্রস্তুতকারী, উপস্থাপনকারী এবং অনুমোদনকারী উভয় পক্ষই সমান দায়ী। এই দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করা এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।আজকের পত্রিকা
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com