তৌহিদ হোসেন:- গত কয়েকদিনের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, সাতদিন ধরে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত বন্ধ, কারণ এই নৌপথে বাংলাদেশের কোনো নৌযান দেখলেই গুলি করা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে। এতে করে সেন্ট মার্টিনে যাত্রী বা পণ্য পাঠানো
যাচ্ছে না। দ্বীপের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দ্বীপে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই গোলাগুলি মিয়ানমার বাহিনী করছে নাকি বিদ্রোহী আরাকান আর্মি, এ নিয়ে কিছু প্রাথমিক অনিশ্চয়তা ছিল। তবে স্থানীয় স্পিডবোট চালকের মতে গুলি ছুড়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এক পত্রিকায় নাফ নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে।
গুলি যেই করে থাকুক, এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশের দু’টি স্থানের মধ্যে যাতায়াত করতে গিয়ে কেউ পাশের দেশ থেকে আক্রান্ত হবে- এটা চলতে দেয়া যায় না। ন্যূনতম সংজ্ঞা ধরলেও এটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর নিঃসন্দেহে একটি আঘাত। আমাদের নৌ বাহিনী আছে, আছে কোস্ট গার্ডও।
অনেক পয়সা খরচ করে দুটো পুরনো সাবমেরিনও কিনেছি। বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে বিরাট কোনো শক্তিশালী বাহিনী হয়তো নয় এরা। তবে আমি বিশ্বাস করি না যে, গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত মিয়ানমার এতোই শক্তিশালী যে, নাফ নদীর মোহনা এবং সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত জলপথকে নিরাপত্তা দেয়ার সামর্থ্য আমাদের নৌ বাহিনীর নেই।
২০১৭ সালে যখন মিয়ানমার সেনাদের গণহত্যার মুখে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে, অভ্যন্তরীণ বিষয় বিধায় আমরা কোনো পদক্ষেপ নিইনি। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো কর্ম যখন প্রতিবেশীর জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করে, যেমনটি করেছে শরণার্থী শিবিরে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার দীর্ঘ উপস্থিতি, তখন আর তা পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। কিন্তু আমরা বরাবর খুবই সংযত আচরণ করেছি, বলা যায় অনেকটাই মিয়ানমারের অপরাধী জান্তার তুষ্টিবিধানের চেষ্টাই করেছি। তড়িঘড়ি একটা চুক্তিসই করেছি যার প্রায় সব শর্তই মিয়ানমার জান্তার পক্ষে। ফলশ্রুতিতে গত প্রায় সাত বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই সৃষ্টি হয়নি। বার বার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমারের জঙ্গি বিমান, আমরা শুধু নম্র, ভদ্রভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছি। আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাদের যুদ্ধের গোলা এপারে এসে হতাহত করেছে বাংলাদেশের মানুষকে, আমরা মেনে নিয়েছি তাও। আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে মিয়ানমার সেনারা বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা সসম্মানে তাদের ফেরত দিয়েছি। গত সাত বছরে আমাদের প্রদর্শিত বিনম্র আচরণ মিয়ানমারে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে যে, বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই, তাদের যে কোনো অপকর্মই বাংলাদেশ শান্তভাবে মেনে নেবে।
তাহলে কি করতে পারে বাংলাদেশ? যুদ্ধ করবে? অবশ্যই না। কোনো দেশের সামরিক শক্তি শুধু যুদ্ধ করার জন্য নয়, শক্তি প্রদর্শন বলেও একটা কথা আছে। প্রথম যেদিন গুলি হলো স্পিড বোটের উপর, সেদিনই নৌ বাহিনীর দু’টো করভেট বা তিনটি প্যাট্রল ভেসেল অবস্থান নিতে পারতো বাংলাদেশের জলসীমায় মিয়ানমারের বিপরীতে। এখনো এ কাজটি করা যায়, যাতে গুলি করছে যারা তারা উপলব্ধি করে যে, বাংলাদেশ এ ধরনের অপকর্ম মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এরপরও যদি তারা দুঃসাহস দেখায়, তাহলে সেই গুলির উৎস লক্ষ্য করে কিছু গোলাবর্ষণ করতে পারে আমাদের জাহাজ। বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন আলাপ- আলোচনায় আমার মনে হয়েছে যে, কোনো কারণে যুদ্ধ লেগে যায় কিনা আমরা সে আতঙ্কে ভুগছি। মিয়ানমার কোনো পরাশক্তি নয়। সংঘাতের আশঙ্কায় তাদের কিল খেয়ে কিল হজম করতে থাকা কোনো বিকল্প হতে পারে না বাংলাদেশের জন্য।
মো. তৌহিদ হোসেন
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
১৪ জুন ২০২৪
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com