ডেস্ক রির্পোট:- প্রথমবারের মতো প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আগামী ৬ই জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উত্থাপিত হবে। তবে বিশাল আকারের এই বাজেটে বিদেশি ঋণের বোঝা আরও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দেশে ক্রমেই বাড়ছে ঋণের পরিমাণ। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধেও চাপ বাড়ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের বড় অংশ যাবে ঋণের সুদ পরিশোধে। দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি। বিদেশি ঋণের প্রাক্কলন করা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে সুদ পরিশোধ ব্যয়ে।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে কাক্সিক্ষত হারে দেনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ এয়ারলাইন্সগুলো তাদের আয় দেশে নিতে পারছে না।
অন্যদিকে বড় মেগা প্রকল্পগুলোর চলমান ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে দিন দিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। এখন ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৩ বিলিয়নের ঘরে। ওদিকে বিদেশি ঋণও পাওয়াও মুশকিল হচ্ছে। আবার যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার বেশির ভাগ অংশই ব্যয় হচ্ছে ঋণ ও সুদ পরিশোধে। এমনি পরিস্থিতিতে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে আনা, রিজার্ভ বাড়ানোর মতো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে সুদাসল পরিশোধের বড় চাপ সার্বিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি আরও বাড়াবে। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অনেক খাতের ব্যয় কাটছাঁট করে ঋণ পরিশোধে দিতে হবে। এতে জীবনযাত্রার উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এর বাইরেও ডলারের দামে ঊর্ধ্বমুখী অস্থিরতা চলতে থাকলে এবং আন্তর্জাতিক সুদহার বৃদ্ধিতে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়ের পরিমাণ বাড়তে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে প্রতি বছরই ঋণের বোঝা বাড়িয়ে চলছে সরকার। বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া এই ঋণের সুদ ব্যয় গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণে পৌঁছেছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশি ঋণের সুদ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হবে। আগামী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এটি পরিবর্তন হতে পারে। যদিও প্রাথমিকভাবে আগামী অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকাকে ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ৩৫ শতাংশেরও বেশি। দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বড় হওয়ার কারণেই সুদ পরিশোধে বরাদ্দ বেশি রাখতে হচ্ছে। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বড় অংশ ব্যয় হবে।
বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ঋণ: অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্যও সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে যাচ্ছে। আগামী বাজেট হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ হিসেবে। ঋণের পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। আগামী অর্থবছরে মোট ঋণের মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে দেশি ঋণ। দেশি ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য উৎস থেকে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
সুদ পরিশোধে বরাদ্দ বাড়ছে: অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সুদ পরিশোধের জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বড় আকারের অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। রাজস্ব আদায় প্রত্যাশা মতো না হওয়ার পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয় মেটানো এসব ধরে নিয়েই সরকার বড় আকারের ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এই ঋণের বিপরীতেই গুনতে হবে বড় অঙ্কের সুদ। বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ থাকবে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি এবং বিদেশি ঋণের সুদ ২০ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ বরাদ্দ দ্বিগুণের কাছাকাছি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সুদ খরচ বাবদ ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, অর্থবছর শেষে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
অর্থ বিভাগের বাজেট তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি বছরই বাজেটে সুদ ব্যয় বেড়ে চলেছে। যেমন, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় ছিল ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ৯০ হাজার ১৩ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় হয় ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। মূল বাজেটে যা ছিল ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ খাতে ব্যয় হয় ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সুদ ব্যয় পাঁচ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়বে। কারণ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমাগত সংকট বাড়ছে। অন্যদিকে রাজস্ব আয় তেমন বাড়াতে পারছে না। তার মতে, আগামী অর্থবছরে ডলার সংকট থাকলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের কারণে বাড়তি চাপে থাকবে। রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় না বাড়লে আগামী অর্থবছরের বাজেট চাপে থাকবে। আগামী দিনে ঋণ হবে বড় বোঝা। বিদেশি ঋণ নিয়ে সরকার বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতও বিনিয়োগের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তবে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ না বাড়লে ঋণ পরিশোধ কঠিন হতে পারে। সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এই সব ঋণ নেয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চীন ও রাশিয়ার স্বল্প মেয়াদের ঋণের কারণে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। ইতিমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কিস্তিও শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধও শিগগিরই শুরু হবে। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে অন্য মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে। অন্যদিকে ঋণের ছাড় আগের তুলনায় খুব একটা বাড়েনি। ইআরডি সূত্র বলছে, জুলাই-এপ্রিল সময়ে সব মিলিয়ে ৬২৮ কোটি ডলার বাংলাদেশে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫৯১ কোটি ডলার।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com