ডেস্ক রির্পোট:- আটা, ময়দা, সুজি দিয়ে সাভার ও কুমিল্লার কারখানায় বানানো হতো নকল অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট-ক্যাপসুল। এরপর সেগুলো ট্রাক বা পিকআপে বরিশালে মজুত করা হতো। সেখানে গুদামজাত করে পরে ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সরবরাহ করত সংঘবদ্ধ চক্র। ১০ বছর ধরে এ প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)-এর অভিযানে এ চক্রের পাঁচজন গ্রেফতার হলে উঠে আসে প্রতারণার চিত্র।
শুধু অ্যান্টিবায়োটিক নয়, লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যালবুমিন ইনজেকশন নিয়েও চলছে ভেজাল সিন্ডিকেট। কিন্তু এ নিয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। ইনজেকশন পুশ করার পরই অনেক সময় রোগী মারা যাচ্ছে। দোষ গিয়ে পড়ছে ডাক্তারদের ঘাড়ে। তাই অনেক চিকিৎসকই ঝুঁকি এড়াতে এ ওষুধ এখন আর ব্যবহার করছেন না। গত বছরের নভেম্বরে এক নকল অ্যালবুমিন প্রস্তুতকারীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক মাস আগে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত এক রোগীকে অ্যালবুমিন ইনজেকশন দেওয়ার পর সেই রোগী মারা যান। এরপর আরও কয়েকজন রোগীকে ওই ইনজেকশন দেওয়ার পর জটিলতা দেখা দেওয়ায় আইসিইউতে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়। পরে ওসমানী মেডিকেলের চিকিৎসকরা অ্যালবুমিন ওষুধ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু এ হাসপাতাল নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালেও ভেজাল অ্যালবুমিন নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় চিকিৎসকদের।
বিএসএমএমইউর গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, ‘ওষুধে ভেজাল থাকলে রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়। মাঝেমধ্যেই ভেজাল অ্যালবুমিন পাওয়া যায়। এমনিতেই অ্যালবুমিনে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। অনেক সময় রোগীর আইসিইউর প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে যদি ভেজাল থাকে তাহলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়।’
ভেজাল ওষুধ তৈরির অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে ওষুধ ও কসমেটিক আইন-২০২৩ পাস করেছে সরকার। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ১ হাজার ৬৯৬টি মোবাইল কোর্ট, আটটি ড্রাগ কোর্ট ও ৪৪৭টি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। তবে ভেজাল ওষুধের জন্য জেলে দেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত বছরের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভেজাল হ্যালোথেনে ঘটেছে রোগীমৃত্যুর ঘটনা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘হ্যালোথেন ওষুধের দোকানে বিক্রি হয় না। হাসপাতালগুলো কোম্পানির এজেন্টের মাধ্যমে ওষুধগুলো কিনত। যেহেতু ওষুধটি ফার্মেসিতে বিক্রি হয় না, তাই আমরা জানতাম না ওষুধটি নকল হচ্ছে। হ্যালোথেন ছাড়াও অন্যান্য ভেজাল ওষুধ ধরতে মাঠ পর্যায়ে পোস্ট মার্কেট সার্ভিল্যান্স ও কন্ট্রোল করা হয়। তবে সমস্যা হলো আমাদের জনবলের ঘাটতি আছে। মাঠ পর্যায়ে এক-দুজন কর্মকর্তা কাজ করেন।’
ডিবিসূত্রে জানা যায়, হুবহু ‘আসল’ মোড়কে গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে সংঘবদ্ধ চক্র; যা দেখে ভোক্তাদের আসল-নকল পরখ করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধ করে জীবন বাঁচাতে মানুষ ওষুধ সেবন করে। কিন্তু জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল! ভেজাল ওষুধ তৈরি এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত চক্রকে ধরতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।’ এ চক্রকে সহযোগিতা করছেন অতিমুনাফালোভী কিছু ফার্মেসি মালিক। মিটফোর্ডকেন্দ্রিক কিছু অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ী এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। এখান থেকে পাইকারিভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ ভেজাল ওষুধ। গ্রামগঞ্জে ক্রেতার হাতে পৌঁছে যাচ্ছে প্রাণঘাতী এসব নকল ওষুধ। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘খাবার এবং ওষুধে ভেজালকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু দেশে ভেজাল ওষুধ কারবারিদের কোনো দৃষ্টান্তমূলক সাজা এখন পর্যন্ত মেলেনি। মিটফোর্ড ঘিরে এ চক্রের কথা সবার জানা। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।’ এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘ওষুধে ভেজাল দেখার কাজ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের। আমি তাদের এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি।’
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com