ডেস্ক রির্পোট:- চলতি বছরের ১৩ই মে পর্যন্ত দেশের নিম্ন আদালতে ২ হাজার ৫৫৪ জনকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০২১টি মামলা। উচ্চ আদালতে মামলাগুলো নিষ্পন্ন না হওয়ায় উল্লিখিত বন্দিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। ফলে বন্দিদের সঙ্গে দুই পক্ষের পরিবারই আছে উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক আর হতাশায়। এই অবস্থায় দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জোর দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজ। আইনজ্ঞদের মতে, ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তিতে মৃত্যুদণ্ড শুনানির এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত বাড়ানো, মামলা জট শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র ডেথ রেফারেন্স শুনানির এখতিয়ার সম্পন্ন বেঞ্চ গঠন করা হলে এসব মামলা নিষ্পন্ন করা সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টে ১ হাজার ২১টি ডেথ রেফারেন্স মামলা আছে এবং এ সংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ২৫১৫ জন বন্দি কারাগারে আছেন। ঢাকা বিভাগের ২০৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১ জন, রাজশাহীর ১৯৬ জন, রংপুরের ৮০ জন, চট্টগ্রামের ৩১৪ জন, সিলেটের ১৩৮, খুলনার ১৮১ ও বরিশালের ৬৯ জন বন্দি আছেন। নিয়মিত ডেথ রেফারেন্স মামলা পরিচালনা করেন এমন আইনজীবীরা বলেন, হাইকোর্টে বিচারিক আদালতের রায়ের পর মৃত্যুদণ্ড বা ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তিতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগে। আইন ও বিধি অনুযায়ী, বিচারিক আদালতে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে কারাবিধি (বাংলাদেশ জেল কোড) ৯৮০ অনুযায়ী তাকে কারাগারের বিশেষ সেলে রাখা হয়, যা কনডেম সেল নামে পরিচিত।
হাইকোর্টের বিচারে মৃত্যুদণ্ড রহিত (যাবজ্জীবন বা অন্য সাজা) হলে রাখা হয় সাধারণ সেলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী, হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া ফাঁসির সাজা কার্যকর করা যায় না। এজন্য দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির রায়সহ যাবতীয় নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠাতে হয়। এটিকে বলে ডেথ বা কোর্ট রেফারেন্স। পেপারবুক যাচাই সাপেক্ষে মামলাগুলো পর্যায়ক্রমে শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ওঠে। হাইকোর্টের পর আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ দণ্ড রিভিউ করতে পারে। শেষ সুযোগ হিসেবে দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও করা যায়। এ আবেদন নাকচ হলে কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অভিমত, আইন ও বিচারব্যবস্থা যুগোপযোগী না হওয়া, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, আইনজীবীদের আবেদনে তারিখের পর তারিখ শুনানি মুলতবি থাকা, বিচারকের অপ্রতুলতা ও ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চের স্বল্পতা প্রভৃতি কারণে মামলার জটে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি এখন বাস্তবতা।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম. এ. মতিন বলেন, ডেথ রেফারেন্স শুনানি দীর্ঘ সময় লাগার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সময়মতো বিচারিক আদালত থেকে রেকর্ড না আসা, যথাসময়ে পেপার বুক তৈরি না হওয়া ও ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে দক্ষ বিচারপতির অভাবে বছরের পর বছর মামলাগুলো আটকে থাকে। সাবেক এই বিচারপতির পরামর্শ- ডেথ রেফারেন্স শুনানির গতি বাড়াতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বিচারিক আদালতে রায় হওয়া মামলার রেকর্ড, নথিপত্র যথা সময়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির বেঞ্চে দক্ষ বিচারপতি বিশেষ করে বিচারিক আদালতে সেশন জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে এমন বিচারকদের দিতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু পেপার বুক তৈরি করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সেজন্য পেপার বুক বাদ দিয়ে বিচারিক আদালতের রেকর্ড দেখেই মামলার শুনানির বিধান করা যেতে পারে।
হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ড. মোহাম্মদ আবু তারিক বলেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি বছরের পর বছর পড়ে থাকে না। ডেথ রেফারেন্স শুনানির বেঞ্চে দক্ষ, সাহসী ও সূক্ষ্ম জ্ঞানসম্পন্ন বিচারপতি, অল্প কথায় রায় লিখতে পারে এবং ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমন বিচারপতিদের যুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে দক্ষ কর্মকর্তাও লাগবে।
মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তিতে মৃত্যুদণ্ড শুনানির এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত বাড়াতে হবে। মামলা জট শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুধুমাত্র ডেথ রেফারেন্স শুনানির এখতিয়ার সম্পন্ন বেঞ্চ গঠন করার পরামর্শও দেন এই আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, নিম্ন আদালতের প্রদত্ত অধিক সংখ্যক মৃত্যুদণ্ডাদেশের ফলে উচ্চ আদালতে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ আদালত ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলেও বিচারিক আদালত থেকে নতুন নতুন ডেথ রেফারেন্স মামলা এসে সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে নিষ্পত্তির চেয়ে জমাকৃত মামলার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এই অবস্থায় বিচারিক আদালতগুলোকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে এবং অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে রায় প্রদান করা উচিত। তিনি আরও বলেন, আইনজীবীদের মধ্যে থেকে ডেথ রেফারেন্স মামলা পরিচালনায় দক্ষ এমন আইনজীবীদের মধ্যে থেকে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়ে বেঞ্চ গঠন করে দেয়া যেতে পারে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনের মতে, হাইকোর্টে বিচারক স্বল্পতার কারণে ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ কম। ফলে মামলা বাড়ছে। বিচারে কিছুটা ধীরগতির। কিছু মামলায় আমরা দিনের পর দিন আদালতে গিয়েছি। কিন্তু আসামির আইনজীবীর সেদিকে নজর নেই।মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com