ডেস্ক রির্পোট:- শায়েস্তা খাঁর আমল। টাকায় আট মণ চাল। তিনশ’ বছরের বেশি সময় পর এই কাহিনী মৃতপ্রায়। এই প্রজন্মের কতো জনই বা তা জানে? যারা জানে তারাও কি বিশ্বাস করে! এক সময় ভোট ছিল এই দেশে উৎসব। কারচুপি, জালিয়াতি, সংঘাত যে ছিল না- এমন নয়। তবে ভোটকেন্দ্রে লম্বা লাইন
ছিল চেনা দৃশ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে, রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে ভোট দিতে হতো। পায়ে হেঁটে, রিকশায়, নৌকায় কেন্দ্রমুখী হয়েছেন মানুষ। ফজর থেকে মাগরিব। দৃশ্যপট এমনই ছিল।
এ প্রজন্মের অনেকেই এটা বিশ্বাস করতে চাইবে না। এটা তো তাদের কাছে শায়েস্তা খাঁর আমলের মতোই ব্যাপার। কারণ গেল পনের বছরের ছবি যে একেবারেই আলাদা। শূন্য ভোটকেন্দ্র। অনেক অপেক্ষার পর কেউ আসেন। তারাও যে সবাই নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারেন তা নয়। রীতিমতো মাইকিং করেও ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়া যাচ্ছে না। স্থানীয়, কি জাতীয় সব নির্বাচনেই একই পরিস্থিতি।
রাগ, গোস্সা, ক্ষোভ, অভিমান। ভোটাররা যেন পণ করেছেন তারা কিছুতেই ভোট দেবেন না। টিভি পর্দায় কিংবা সরজমিন দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিষয় দেখে আসছি। সকাল বেলা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নানা বয়ান হাজির করেন। কখনো বলেন, ঠাণ্ডা। একটু রোদ উঠলেই ভোটাররা আসবেন। কখনো বলেন, বৃষ্টি। বৃষ্টি থামলে ভোটাররা আসবেন। কখনোবা বলা হয়, তীব্র রোদ। বিকালের দিকে ভোটাররা আসবেন। বুধবারের উপজেলা নির্বাচনের পর নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। দিনের শেষে তিনি জানান, ‘গড়ে ৩০-৪০% এর মাঝামাঝি ভোটের হার হতে পারে। এর একটি কারণ হতে পারে বর্ষণ। সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি ছিল। আবার ধান কাটার মৌসুম ছিল। আমরা জানার চেষ্টা করেছি। আমাদের বলা হয়েছে, অনেকেই ধান কাটতে থাকায় ওরা ভোট দিতে আসেনি।’
এটা বারবার লেখা হয়েছে। তবুও অতি ব্যবহারে তা ক্লিশে শোনায় না। গণতন্ত্র এক জীবন ব্যবস্থা। দেশে দেশে তার নানা রূপ। কিন্তু এর প্রথম এবং গোড়ার কথা ব্যালট। যে ব্যালটের মাধ্যমে জনগণ তার মালিকানা ঘোষণা করে। তার মতামত দেয়। জনগণ কেন ভোট দিতে যায় না সে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যা বলেছেন তা ভোটারদের নিয়ে রীতিমতো রসিকতা। তিনি সিইসি হওয়ার পর অনেকেই আশার কথা শুনিয়েছিলেন। তাদের সেই আশা অবশ্য বহু আগেই মিইয়ে গেছে।
গেল সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দলগুলো অংশ নিচ্ছে না। যদিও বিএনপি’র কিছু নেতাকর্মী এতে অংশ নিচ্ছেন। তাদের ইতিমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে। শাসক দলের একাধিক নেতা প্রতিটি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অনেকটা ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের মডেলে। তবে এ ব্যবস্থাও ভোটারদের টানতে পারেনি। কেন ভোটাররা কিছুতেই কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন না। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভোটাররা নিজেদের গুরুত্বহীন মনে করছেন। তারা মনে করছেন, তাদের ভোট দেয়া বা না দেয়াতে কিছু আসবে যাবে না। ফলাফল যা হওয়ার সেটাই হবে। এটিই মূলত তাদের কেন্দ্রবিমুখ করেছে। এটাও তারা দেখছেন, এ ধরনের ভোটে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। অনেকটা দলীয় কাউন্সিলের মতো। যেই বিজয়ী হন তারা একটি দল বা জোটেরই সমর্থক। এ কারণে ভোটাররা তাদের শ্রম ও সময় ব্যয় করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে তাদের অতীত অপমান ও লাঞ্ছনার গল্প। অনেকক্ষেত্রেই ভোট দিতে গিয়ে তারা শুনেছেন তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। কখনো ভোট দিতে পারলেও তা নিজের ইচ্ছায় দিতে পারেননি। কেন্দ্রে উপস্থিত প্রভাবশালীরা তাদের নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন। এসব অপমান স্মৃতিতে নিয়ে ভোটাররা আর কেন্দ্রে যাননি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে বিএনপি বা বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হবেন না।
এই যখন অবস্থা তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিংবা কারও কারও কথা শুনে মনে হবে, ধানকাটা, বৃষ্টি, রোদ বাংলাদেশে যেন আগে কখনো হয়নি। যদিও এ বছর তাপমাত্রা অতীতের তুলনায় বেশি। তবে ভোটের দিন পরিস্থিতি তেমন ছিল না। কে না জানে, এসব ভোটারের কেন্দ্রে না যাওয়ার কারণ নয়। কেউ কেউ আবার উন্নত দেশের সঙ্গে মেলাবেন। বলবেন, ইউরোপে ভোটের হার কতো, আমেরিকায় কতো? কিন্তু বাংলাদেশের ‘একদিনের বাদশাহরা’ কেন ভোটকেন্দ্রে যাওয়া বন্ধ করলেন সে কারণ তারা খুঁজবেন না।
দৃশ্যত বাংলাদেশের রাজনীতি স্থবির। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটি পুনর্গঠন কি সম্ভব? এটি পুরোটাই নির্ভর করছে ভোটারদের কেন্দ্রে ফেরার ওপর। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কিংবা রাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা কি তাদের কেন্দ্রে ফেরাতে চান সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মানবজমিন
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com