চট্টগ্রাম:- চট্টগ্রামে গত বছর সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ জব্দ করার পর তিন মাসের মধ্যে কোনো দাবিদার হাজির হননি থানা কিংবা ডিবি কার্যালয়ে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে চোরাচালানের মামলায় মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সংযোগ এবং চট্টগ্রামের দুই বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। এর পরই ওই দুই ব্যবসায়ী ডিবি থেকে মামলাটি পিবিআইয়ে স্থানান্তর করতে ছুটে যান ঢাকায়। পরে পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স কার্যত জোর করে চাঞ্চল্যকর মামলাটির তদন্তভার নেয়।
মামলার তদন্ত পিবিআইর হাতে যাওয়ার পর ১৮০ ডিগ্রি পাল্টে যায় তদন্তের ফল। হঠাৎ করে উদয় হন ওই স্বর্ণের ২৪ মালিক। ডিবির তদন্তকালে এক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুই বড় ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। তবে পিবিআই তাদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, একবারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান তারা। রহস্যে ভরপুর তদন্ত শেষে দুই ব্যবসায়ীর পাশাপাশি মামলার পাঁচ আসামিকেও অব্যাহতি দিতে আদালতে সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই।
কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে আনার সময় গত বছরের ১৬ জুন চট্টগ্রাম নগরীর কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকায় সাড়ে সাত কোটি টাকা মূল্যের এ স্বর্ণপিণ্ড ধরা পড়ে। যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশি করে স্বর্ণসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে সিএমপির কর্ণফুলী থানা পুলিশ। এ মামলার আসামি করা হয় বাঁশখালীর সাধনপুরের নয়ন ধর, তাঁর স্ত্রী বসুন্ধরা জুলি ধর, কৃষ্ণ ধর এবং চন্দনাইশের বণিকপাড়ার টিপু ধর অলককে। অবৈধ স্বর্ণ গলিয়ে ছোট ছোট দণ্ড ও পাতলা পাত বা বিস্কুট আকৃতির করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ থেকে কার্যত ‘জোর’ করে মামলাটির তদন্তভার নিয়ে নেয় পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো। এর আগে ডিবি মামলাটির রহস্য উন্মোচন, মূল হোতা শনাক্তসহ তদন্ত ৯০ ভাগ শেষ করে ফেলায় তদন্তভার কোনোভাবেই ছাড়তে রাজি ছিল না। তবে বর্তমানে ঢাকার একটি থানার প্রভাবশালী এক ওসি মামলাটি ডিবি থেকে পিবিআইয়ে নিয়ে যেতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদবির ও কলকাঠি নাড়েন। তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন।
জানা গেছে, পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি তাদের কাছে হস্তান্তর করতে চিঠি দিলেও দুই মাস ডিবি তদন্তভার ছাড়েনি। কিন্তু নাছোড়বান্দা পিবিআই তদন্তভার পেতে মরিয়া ছিল। পিবিআই তদন্তভার নিয়ে চোরাচালানের মূল হোতাসহ আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে চলতি মাসের শুরুতে।
ডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পিবিআই জোর করে তদন্তভার নিতে মরিয়া হয়ে ওঠায় আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে, মামলার মোড় ভিন্ন দিকে চলে যেতে পারে। সেই সন্দেহই সত্যি হলো। গত বছরের আগস্টে তদন্তভার নিয়ে নেয় পিবিআই।
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল হক বলেন, পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে মামলার তদন্তভার তাঁকে দেওয়া হয়। তদন্তে যেসব তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন, সেই অনুসারে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। ওই স্বর্ণ চোরাচালানের নয়। এর মালিক কক্সবাজারের ২৪ জন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ওই ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ ধরা পড়ার পরপরই ডিবির কাছে না গিয়ে তদন্তভার পিবিআইর হাতে যাওয়ার পর কেন মালিকানা দাবি করল তা তাদের বিষয়।
এক প্রশ্নের জবাবে ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল বলেন, ডিবির তদন্তের সময় জবানবন্দিতে আসা চট্টগ্রামের দুই বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিধান ধর ও কৃষ্ণ ধরকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। তাঁর তদন্তে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পাননি। ডিবির তদন্তে স্বর্ণ চোরাচালানে রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্টতা পেলেও পিবিআই সে রকম কিছু পাননি বলে জানান তিনি।
মহানগর ডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, চার আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোয়েন্দা পুলিশ রিমান্ডে নিলে জিজ্ঞাসাবাদে চোরাচালানে জড়িতদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেন। আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে চোরাচালানে জড়িত দুই মূল হোতার নাম বলেন। আসামিদের জবানবন্দি ও তদন্তে উঠে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে আসামিদের মোবাইল কললিস্টেও একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। সব তথ্যই মামলার কেস ডকেটে রয়েছে। তার পরও পিবিআই কীভাবে একে ‘তথ্যগত ভুল’ উল্লেখ করে আসামিদের বাঁচিয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে, তা বোধগম্য হচ্ছে না।
মহানগর ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এ চোরাচালানে কারা জড়িত ছিল, তা আমার তদন্তে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। মূল হোতারা চিহ্নিত হওয়ায় দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু চোরাচালানে জড়িত ব্যক্তিরা কূটকৌশল করে মামলাটি ডিবি থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায়। চোরাচালানে জড়িতদের একটি পক্ষ আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল, ‘আমরা ঢাকায় যাচ্ছি– মামলাটি পিবিআইয়ে নিয়ে যাব। তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। তাদের কথা মতো মামলাটি সত্যি সত্যি পিবিআইয়ে চলে যায়। পরে তদন্তে কী হয়েছে তা আমার জানা নেই।’
জবানবন্দিতে নাম জড়ানো স্বর্ণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণ ধর বলেন, ডিবি মামলার তদন্ত করার পর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আসামিদের দিয়ে জবানবন্দিতে তাঁর ও বিধান ধরের নাম বলানো হয়। তার পর তিনি নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করেন। সেই আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিবিআইয়ে পাঠান বলে তিনি জানতে পেরেছেন। পরে মামলায় কী হয়েছে জানেন না।
অভিযুক্ত বিধান ধর বলেন, ‘আমরা স্বর্ণ ব্যবসায়ী নেতা হওয়ায় এক বছর আগে ডিবির সঙ্গে আমাদের একটি ঝামেলা হয়। তার পর সুযোগ পেয়ে এ মামলায় ডিবি আমাদের ফাঁসিয়ে দেয়। আমরা নির্দোষ।’
যা বলেছিলেন দুই আসামি
ডিবির তদন্ত চলাকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি নয়ন ধর ওরফে নারায়ণ বলেন, ‘কক্সবাজারের বাপ্পু নামের এক ব্যবসায়ী সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ নিয়ে এসে চট্টগ্রামের হাজারিগলিতে বিশ্বকর্মা বুলিয়ান জুয়েলারির মালিক বিধান ধর ও কৃষ্ণ ধরকে দিতে বলেন।’ অপর আসামি টিপু ধরের জবানবন্দিতেও বিধান ও কৃষ্ণের নাম উঠে আসে।
ওসির তদবির
চট্টগ্রামের এ দুই বড় ব্যবসায়ীর নাম জবানবন্দিতে আসার পর তারা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই রবিউলকে প্রথমে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। অভিযুক্ত কৃষ্ণ ধরের এক বন্ধু ঢাকার একটি থানার প্রভাবশালী ওসি সরাসরি চট্টগ্রামে এসে রবিউলের সঙ্গে দেখা করে মামলা থেকে বিধান ধর ও কৃষ্ণ ধরকে বাঁচাতে তদবির করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ওই ওসি মামলাটি ডিবি থেকে পিবিআইয়ে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করেন।
ওই ওসি ডিবির কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি না পারলে বলো। আমি মামলা পিবিআইয়ে নিয়ে যাবো। তবুও আমার বন্ধু কৃষ্ণকে বাঁচাতে হবে।’ তার পরই ডিবির মামলাটি পিবিআইয়ে চলে যায়।
পিবিআইর প্রতিবেদন
ওই দুই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি পিবিআই মামলার পাঁচ আসামিকেও নির্দোষ উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই স্বর্ণ কক্সবাজারের ২৪ ব্যবসায়ীর বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন পিবিআই।
পিবিআই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ওই ব্যবসায়ীরদের থেকে বাপ্পু পুরোনো ছোট ছোট অলংকার সংগ্রহ করে তা নতুন ডিজাইনের করে তৈরি করতে চট্টগ্রামে পাঠান। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ২৪ জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অলংকার কেন গলিয়ে পাত ও গোল পিণ্ড তৈরি করা হবে? কথিত কাগজ ও মৌখিক দাবি নিয়ে হাজির হওয়ায় স্বর্ণপিণ্ডগুলো আসলে কার, তা নিয়ে রহস্যের শেষ নেই।
প্রথম দিকে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ডিবি কর্মকর্তা জানান, অবৈধ স্বর্ণকে বৈধ করতে চোরাচালানকারীদের এটি একটি নতুন কূটচাল। তাদের চালের সঙ্গে তদন্ত সংস্থার মানুষও জড়িত। পুলিশ ও ডিবির তদন্তের সময় কথিত ওই ২৪ মালিকদের কেউ থানায় কিংবা ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে মালিকানা দাবি করেননি। পরে যা ঘটেছে তা পুরোটাই সাজানো।
ডিবির তদন্তে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ চোরাচালান করে আনার তথ্য উঠে আসে। আসামি ও কয়েকজন রোহিঙ্গার মোবাইল কললিস্টে এমন সম্পৃক্ততা পায় ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে দুই আসামি রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে এ স্বর্ণ মিয়ানমার থেকে পাচার করে আনা হয় বলে জানান।সমকাল
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com