ডেস্ক রির্পোট:- সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ নিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত চার বছরে দেশের ম্যালেরিয়া পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। বরং প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেড়েছে। গত চার বছরে রোগী বেড়েছে চার গুণ।
কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতি, মশা ও মানুষের আচরণে পরিবর্তনের কারণে ম্যালেরিয়া নির্মূলে গতানুগতিক পদ্ধতি কোনো কাজে আসছে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। বরং এতে শুধু সরকারের অর্থ অপচয় হবে।
সরকারের ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এক হাজার ১৫৮ জন ম্যালেরিয়ার রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে রাঙ্গামাটিতে, ৪০ শতাংশ বান্দরবান ও ১২ শতাংশ কক্সবাজারে। এই সময়ে মারা গেছে দুজন।
গত বছর ২০২৩ সালে দেশে ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয় ১৬ হাজার ৫৬৭ জনের। মৃত্যু হয় ছয়জনের।
এর আগে ২০২২ সালে শনাক্ত হয় ১৮ হাজার ১৯৫ জনের। মৃত্যু হয় ১৪ জনের। ২০২১ সালে আক্রান্ত হয় সাত হাজার ২৯৪ জন এবং মৃত্যু ৯ জনের। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ১৩০ জন এবং মৃত্যু ৯ জনের। অর্থাৎ ২০২০ সালের পরবর্তী চার বছরে রোগী বেড়েছে চার গুণ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ২৫ এপ্রিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ন্যায়সংগত বিশ্বের জন্য ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই আরো গতিশীল করতে হবে’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ম্যালেরিয়ায় বিশ্বে ছয় লাখ মানুষ মারা গেছে। এ ছাড়া ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ২৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। ম্যালেরিয়ায় মারা যাওয়া রোগীদের ৯০ শতাংশ আফ্রিকা অঞ্চলের।
দুই জেলায় ৯০% রোগী
সরকারের ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৩টি জেলা ম্যালেরিয়াপ্রবণ। এর মধ্যে দুই জেলা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে ৯০ শতাংশ সংক্রমণ ঘটছে। এটি ১০ বছর ধরে একই হারে চলছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার নিম্নঝুঁকির এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
উচ্চঝুঁকিতে তিন জেলা
২০২৩ সালে মোট রোগীর ৬০.৩৭ শতাংশ শনাক্ত হয় বান্দরবানে, ২৮.৪৫ শতাংশ রাঙ্গামাটিতে এবং ৭.৬১ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয় কক্সবাজারে। ২০২২ সালে ৭৫.৯ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয় বান্দরবান জেলায়, ১৭.৭ শতাংশ রাঙ্গামাটিতে এবং ৪.৬ শতাংশ কক্সবাজারে। এর আগের বছর ২০২১ সালে মোট শনাক্তের ৭১.৭ শতাংশ বান্দরবানে, ২১.৩ শতাংশ রাঙামাটিতে এবং ৪.৯ শতাংশ কক্সবাজারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূলের একই পদ্ধতি অনেক বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে প্রকৃতি, মশা ও মানুষের আচরণে পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে মশা নির্মূল কিংবা রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা কোনোটাই হচ্ছে না। ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে হলে প্রথমে গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, পাহাড়ি এলাকায় কিংবা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে যারা কাঠ কাটে বা কৃষিকাজ করে বা যারা পাহারা দেয়, তাদের মশারি ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে মসকিউটো রিপেলেন্ট প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ কিছু ইনোভেটিভ সলিউশন কিছু মানুষের জন্য নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। এই দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষকে নিয়ে ম্যালেরিয়া নির্মূলে একযোগে কাজ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পার্বত্য অঞ্চলের যেসব জায়গায় যাওয়া খুব কঠিন, যেসব এলাকার স্থানীয় মানুষদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা সম্ভব না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ম ম আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা আশাবাদী। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। তবে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো পার্বত্য তিন জেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ রোগী বান্দরবানে।’
ডা. ম ম আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘রোগী না কমার পেছনে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কিছু এলাকায় রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা ওয়ান থ্রি সেভেন ফর্মুলা অনুযায়ী কাজ করছি। অর্থাৎ ম্যালেরিয়া রোগের শনাক্তকরণ করতে হবে এক দিনের মধ্যে, তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ম্যালেরিয়া নিশ্চিত করে রিপোর্ট দিতে হবে এবং সাত দিনের মধ্যে আশপাশে কোনো রোগী আছে কি না, তারও খোঁজ নিতে হবে। এই ফর্মুলা ব্যবহার করে চীন ম্যালেরিয়া নির্মূল করেছে। প্রত্যেক রোগী আমরা ফলো করছি। গবেষণা ও নজরদারি বাড়ানোসহ বিনা মূল্যে মশারি এবং ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।’
ঢাকায় মিলছে ম্যালেরিয়ার বাহক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষক গত ২৩ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভেতর ও করপোরেশনসংলগ্ন স্থানে পূর্ণাঙ্গ অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পান। মশা ও লার্ভা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে রাখা হয়েছে। লার্ভা থেকে উৎপন্ন পিউপা ও পিউপা থেকে রূপ নেওয়া পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ে আরো কিছু গবেষণা করবেন তাঁরা। তারপর তা প্রকাশ করা হবে।
এ ব্যাপারে গবেষকদলের প্রধান ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘ঢাকায় ম্যালেরিয়ার বাহক পাওয়া গেছে। তাই আমাদের মাঝে নতুন করে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি করছে। আমরা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা ও সেই মশার লার্ভা খুঁজতে গিয়ে অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পেয়েছি। গত ২৩ মার্চ উত্তর সিটিতে ও উত্তর সিটির কাছাকাছি একটা জায়গায় পূর্ণাঙ্গ অ্যানোফিলিস মশা ও মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অনেক লার্ভা আছে সেখানে। সেখান থেকে ১২টি লার্ভা সংগ্রহ করেছি।’কালের কণ্ঠ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com