অর্থনৈতিক রিপোর্টার:- ব্যবসায়ীরা এখন রাজনৈতিক এলিট শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্ক করে সুবিধা আদায় করেন। তারা নীতিমালার গতিমুখ পরিবর্তন করার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। দেশের বেসরকারি ব্যাংকিং খাত ও গার্মেন্টস খাতের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট। গার্মেন্টস মালিকরা একচেটিয়া সুবিধা পেয়েই যাচ্ছেন। অন্যদিকে মালিকদের লুটপাটে বেসরকারি অনেকগুলো ব্যাংক ধ্বংসের মুখে। এগুলো ধ্বংস করতে সরকার ও প্রশাসন সহায়তা করছে। আর দুই অংশের মধ্য থেকে সংসদে ও মন্ত্রিসভায় স্থান পাচ্ছেন তারা। গতকাল সিপিডির ধানমন্ডি কার্যালয়ে প্রফেসর রওনক জাহান ও প্রফেসর রেহমান সোবাহান সম্পাদিত ‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ : ইকোনোমি, পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার’ শীর্ষক বই নিয়ে আলোচনায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা বলেন, শ্রমঘন শিল্প নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। এখনও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে পিছিয়ে আছে দেশ। বিশ্ববাজারে ভালো করতে হলে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। তাদের মতে, জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে চমক নেই। শষ্য উৎপাদন ও সেচ ব্যবস্থাপনার যুগান্তকারী উন্নয়ন হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বড় ভ‚মিকা রাখছে। সমন্বিত শিল্প নীতি প্রয়োজন। যাতে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ হয়। এছাড়া ৫০ বছরে বাংলাদেশের সফলতা যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি স্থায়ী দুর্নীতিও এগিয়েছে। উন্নতি আর দুর্নীতি দুটোই পাশাপাশি এগিয়েছে। সাফল্যের বিপরীতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অনেক বেশি।
অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান বলেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশের সফলতা চোখে পড়ার মতো। এই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে আর্থ-সামাজিক উত্তরণ ঘটেছে। ড. রেহমান সোবহান বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ে এ রকম আরেকটি বই করা হয়েছিল। তখন ২৫ বছরের বাংলাদেশর অর্থনীতি নিয়ে এতটা উচ্চাশা ছিল না। সেখানে গার্মেন্টস সেক্টরে কতগুলো ভ্যালু অ্যাড হতে পারে সে বিষয়ে চিন্তা করা হয়নি। রেমিট্যান্স নিয়ে এতো চিন্তাভাবনা করা হয়নি। এখন পরবর্তী ২৫ বছরে এসব পার্থক্য খুঁজে বের করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় রয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশে অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হয়েছে, সে সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। উন্নয়ন ও কিংবা পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে। গত ৫১ বছরে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন সূচকে উন্নয়ন হয়েছে। সেসব বিষয়ে বইয়ের লেখকরা ডাটা অ্যানালাইসি করে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন।
দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বইটির বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় বলেন, বইতে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ আছে, যা বর্তমানে চলছে। গত কয়েক দশকে ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগের ক্ষমতা কমেছে। বর্তমানে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এই দুই অংশের মধ্য থেকে আমরা দেখেছি সংসদে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মন্ত্রিসভায় স্থান পান।
বইটির প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ওই দুইটি গোষ্ঠী রাষ্ট্র ও সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী। দেশ রাজনৈতিক পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ করছে। অনেকে গ্রহণ করেন সামাজিক ধর্মীয় কৌশল। শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব বেড়েছে। বইটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর থেকে বহু শাসকের সরকার হয়েছে। সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও রাজনৈতিক কারণে তারা বাদ পড়ে যান। তার মানে গণতন্ত্রের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসক বা অনির্বাচিত শাসকদের শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
বইটির আলোচনায় তিনি বলেন, বিরোধী দল না থাকায় সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ দলাদলি ও কোন্দল আরও বাড়বে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত ঘটেছে দুই হাজার ৭১০টি, যার মধ্যে শাসক দল আওয়ামী লীগের ২৩৯ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২০০ জনই নিহত হন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। বর্তমান সরকারের প্রভাবশালীরা পেশিশক্তি প্রয়োগ করছেন ভেতরের প্রতিদ্ব›দ্বীদের বিরুদ্ধে। এমনকি রাষ্ট্রের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও সংঘাতে নেমেছেন। রাষ্ট্রেই একমাত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন না, বরং প্রভাবশালীদের বল প্রয়োগের অনুমতিও তারা দিচ্ছেন।
মতিউর রহমান বলেন, সকল শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দলকে সরকারি দল কোণঠাসা করতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপির তথ্যানুসারে, গত বছরগুলোতে তাদের বিরুদ্ধে এক লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। শাসক দল বর্তমানে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। রাজনৈতিক দল আজ ভবিষ্যতের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়ে গেছে, বরং উল্টো পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে।
সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, রাজনীতি, অতি ধনীর কারখানা হিসেবে গড়ে উঠেছে। আগামীতে অর্থনীতির এজেন্ডাই হবে রাজনীতির এজেন্ডা। তিনি বলেন, শিক্ষা এক সময় সামাজিক উন্নতির চালক ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষা পদ্ধতি আমাদেরকে সস্তা শ্রমের ফাঁদে আটকে ফেলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যেও মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। অপরদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ ধনী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক গ্রæপের বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক প্রধান সৈয়দ আখতার মাহমুদ অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে; উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার; এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন।
সৈয়দ আখতার মাহমুদ বলেন, দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সরকার যে সবকিছু করে দিয়েছে, তা নয়; বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এখন এই সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আগে এই বিষয় যেভাবে কাজ করত, এখন সেভাবে করছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বইটির আরেকজন লেখক সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান দ্বৈত উত্তরণের প্রসঙ্গে বলেন, দেশের যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, এই উত্তরণ তারই প্রতিফলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, এবং ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কি না। শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এত দিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে উচ্চ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি এক শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনাম এ ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তিনি বলেন, নিম্ন আয় ও মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ব্রাজিল ৩৫ বছর ধরে আটকে আছে। ফিলিপাইন ৩৩ বছর ধরে একই জায়গায় আটকে আছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তি, দক্ষতা ও মানব সম্পদের উন্নয়ন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ হলেও উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে এটি আর সেভাবে কাজ করবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে এত দিন এক ধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল, অর্থাৎ এটা চলতে দিতে হবে। কিন্তু তার অভিযোগ, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ কি এফডিআই নির্ভর হবে, না কি অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন করবে, তা নিয়ে ঐকমত্য নেই। সেলিম রায়হান আরও বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশে একধরনের স্থিতিশীলতা আছে। এই চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তা না হলে সংস্কার হবে না; তা না হলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতাও বাড়বে না।
দেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন গড় স‚চক নিয়ে কথা বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তিনি বলেন, দেশে চরম দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের স‚ত্রে তিনি বলেন, দেশে যেমন অসমতার হার সবচেয়ে বেশি, তেমনি ধনীদের ধন সঞ্চয়ের হারও অনেক বেশি। সে জন্য ধনী ও গরিবের সূচক পৃথকভাবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের মানুষের শ্রম ব্যবহারের মধ্য দিয়েই উন্নয়ন হলেও যাঁরা এই শ্রম দিয়েছেন, তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বলে মত দেন অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল হাসান। বলেন, শিল্প খাতের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেক কষ্ট করে দেশের উন্নয়ন অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পশ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মজুরি বাড়েনি। এ ছাড়া যাঁরা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন, তারা নানা ধরনের হয়রানি ও অধিকারহানির শিকার হচ্ছেন।
অনুষ্ঠানের প্রথম ভাগে বইটির অর্থনীতিবিষয়ক ছয়টি প্রবন্ধের লেখক আলোচনা করার পর তার পর্যালোচনা করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া কীভাবে উন্নয়ন হলো, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়। বরং উন্নয়ন হওয়া সত্তে¡ও কেন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হচ্ছে না, এখন সেটা বুঝতে হবে। ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, আমরা যেমন উঠতে পারি, তেমনি পিছলেও যেতে পারি।
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com