ডেস্ক রির্পোট:- জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, ডাক নাম সন্তু লারমা। সাবেক সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা কর্তৃক গড়ে তোলা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন শান্তিবাহিনী পরিচালনা করতেন সন্তু লারমা। তার নামের সাথে মিল রেখেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ইতছড়িতে গঠিত হয় শান্তিবাহিনী নামক বিদ্রোহী দল। পার্বত্য জেলার এই বিদ্রোহী দলকে গেরিলা বাহিনীও বলা হতো।
১৩টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নিজস্বতার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে গড়া এই শান্তিবাহিনীর দাবি ছিল আলাদা একটা রাষ্ট্র। তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় গড়ে উঠবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল।
সন্তু লারমা নিজের স্বার্থে ১৪ দফা দাবি উল্লেখ রেখে সরকারের সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আবদ্ধ হন। যা শান্তচিুক্তি নামে পরিচিত।
শান্তিচুক্তির আগে ২৪ বছরে তিন পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনী ও সাধারণ জনগণসহ (বাঙালি) প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
শান্তিচুক্তির পর থেকে জেএসএস, ইউপিডিএফ, এমএল, জেএল, ত্রিপুরা ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামক একাধিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর একটাই চাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম হবে একটি আলাদা রাষ্ট্র।
এদিকে চুক্তির বিরোধিতা করে প্রসীত খীসার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামক সংগঠন তৈরি হয়। তবে সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার পক্ষ নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসেজেএসএস)। এই নিয়ে শান্তিচুক্তির পরও পাহাড়ে ইউপিডিএফ এবং পিসেজেএসএস সংগঠনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামেনি এত বছরেও।
শান্তিবাহিনী গঠনের ২৪ বছরের বিদ্রোহিতার সুফল একটি শান্তিচুক্তি, আবার শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পর ২০২১ সালে বান্দরবান সীমান্তে আরেকটা কুফল তৈরি করতে পরিপূর্ণভাবে সক্ষম হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে পার্বত্য সন্ত্রাসী গ্রুপ। বম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তরুণ যুবকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। সংগঠনটির নেতৃত্ব দেওয়া টগবগে তরুণের নাম নাথান বম।
বান্দরবান খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল থেকে এসএসসি, বান্দরবান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করে নাথান বম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে রুমা উপজেলার হিডেনপাড়া থেকে যাত্রা শুরু করে ‘কেএনএফ’। ২০১৬ সালের দিকে ১১ যুবক মুনলানইপাড়া থেকে একটা টিম গঠন করে, যা পরবর্তী সময়ে ‘কেএনএফ’ নামে একটি সশস্ত্র গ্রুপে রূপান্তরিত হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে তারা পুরো জেলা থেকে দেড় শতাধিক তরুণকে তাদের দলে ভেড়ায়। এই তরুণদের ইনফেনট্রি ও কমান্ডো প্রশিক্ষণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে। বর্তমানে কেএনএফের সদস্য সংখ্যা ৫ হাজারের মতো।
মনিপুর ও মিজোরামে কুকি-চিনের প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলা থেকে নাথান বম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এর আগে ইউপিডিএফ গঠনের মধ্যে দিয়ে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন জেলা থেকে ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত খীসাও অংশগ্রহণ করে নিজেকে জানান দেন। সেই একই কায়দা অবলম্বন করেছিল নাথান বম।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই বারবার রক্ত ঝরে পাহাড়ে-------
১৯৭৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর দফায় দফায় চলে নিপীড়ন-নির্যাতন-গণহত্যা ও বর্বরতা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়িঘর, মিথ্যা মামলায় ঢুকানো হয় জেলে। আজও পার্বত্যবাসী কাউখালি, লংগদু, ভূষনছড়া, তাইন্দং-তবলছড়ি, লোগাং গণহত্যার কথা মনে করে শিউরে উঠে।
অভ্যন্তরীণ বিরোধের ভয়াবহতা থেকে শুধু আত্মরক্ষাতেই লক্ষাধিক পাহাড়ি নারী-পুরুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা কিংবা নিরাপদ দূরত্বের অন্য কোনো শহরে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পিসিজেএসএস দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, এরা পিসিজেএসএস (সন্তু লারমাপন্থি) এবং পিসিজেএসএস (এমএন লারমাপন্থি) নামে বিভক্ত হয়। স্বজাতের ওপর নিপীড়নের মাত্রা ত্রিমুখী হয়ে যায়। একের পর এক খুন, গুম, অপহরণ, হামলা, বিতাড়িত করা, মুক্তিপণ আদায় করাই তাদের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফের ঝরেপড়া নেতাকর্মীদের নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি দল। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলায় আত্মপ্রকাশ করে দুটি দল। বিগত কয়েক বছর আগে আত্মপ্রকাশ করে মগ লিবারেশন পার্টি এবং কুকি-চিন পার্টি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ৬টি আঞ্চলিক সংগঠন চলমান রয়েছে ও তাদের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এসব সংগঠনের আত্মরক্ষার তাগিদে দেশবিদেশের বিভিন্ন চোরাকারবারি ও সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকে। সাধারণ জনগণকে চাঁদা দিতে হয়।
বিগত ২০১৮ সাল থেকে পিসিজেএসএস এবং ইউপিডিএফ দল দুটোর নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও মামলা শুরু হয়। ফলে উভয় দলের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়।
পার্বত্য সীমান্ত এলাকায় আরাকান বাহিনী আর জেলার অভ্যন্তরে মগ পার্টি নামে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ দৃশ্যমান। তাছাড়া বান্দরবান জেলায় কুকি-চিন নামে আরও একটি সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বাংলাদেশ খণ্ডবিখণ্ড করে আলাদা রাজ্য গঠনের উদ্যোগ পর্যন্ত নিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে দেশদ্রোহী এ বাহিনীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী অভিযানে নেমেছে এবং অখণ্ড বাংলাদেশ রক্ষায় প্রাণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে।
পাহাড়ে শান্তি না ফেরার কারণ----
পাহাড়ের বাসিন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী মনে করছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়ার পেছনে মূল কারণ সংগঠনগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা। শান্তিচুক্তির দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে শান্তি ফেরেনি। পাহাড়ে গুম, খুন, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। সহিংসতার ভয়ে কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন। চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে সরকার ও পাহাড়ের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত।
সরকার বলছে, পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত ও ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। এ ছাড়া ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান। তবে পাহাড়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা বলছেন, এতো দীর্ঘ সময়ে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৮টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ২৯টি ধারার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। ভূমি সমস্যা সমাধানসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলায় ক্ষোভ, হতাশা ও অসন্তোষ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পাহাড়ের নেতারা।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে চুক্তি করেন, যেটিকে ‘শান্তি চুক্তি’ নামে অভিহিত করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরও অস্ত্রের ঝনঝনানি থামেনি পাহাড়ে। নতুন নতুন সশস্ত্র গ্রুপের আবির্ভাব এবং সেগুলোর অন্তর্কোন্দলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলেছে। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের কলহে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জড়িয়ে পড়ছে সংঘাতে।ঢাকা টাইমস
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com