বান্দরবান:- সশস্ত্র হামলা, ব্যাংক লুট ও অপহরণের ঘটনায় বান্দরবানের রুমা উপজেলায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাসিন্দাদের অনেকেই আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। গতকাল রোববার সকাল থেকে রুমার অভ্যন্তরীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫ গুলির হদিস ছয় দিনেও মেলেনি। গ্রেফতার করা যায়নি ঘটনায় জড়িত কাউকে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, জড়িতদের গ্রেফতার ও উদ্ধার অভিযান চলছে। গতকাল বান্দরবানে বিশেষ অভিযান চালিয়ে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বমকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সন্ত্রাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত বান্দরবানের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশের যৌথ অভিযান চলবে। গতকাল বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড রিজিয়ন মাঠে অভিযানের খোঁজখবর নেওয়ার পর সাংবাদিকদের একথা বলেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বলেন, কেএনএফের সঙ্গে বম জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর একটি সংখ্যা জড়িয়ে পড়েছে। বম জনগোষ্ঠীর অনেক নেতা জনসাধারণের সঙ্গে মিশে থেকে কেএনএফকে সব তথ্য সরবরাহ করে চলেছে। বম পাড়াগুলোতে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের আনাগোনা রয়েছে সব সময়। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হলে তাদের সোর্স সহজে চিহ্নিত করা যাবে। স্থানীয়রা জানান, কেএনএফ রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও আলীকদমের পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ আদায় করে ত্রাস সৃষ্টি করছে। এছাড়া রুমার মুন্নুমপাড়া, আত্তাপাড়া, বেতেলপাড়া, রনিনপাড়া ঘিরে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
স্থানীয়রা জানান, গতকাল সকাল থেকে বান্দরবান-রুমা সড়কে গণপরিবহণ চলাচল করলেও উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা। যে কারণে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর, বর্ষবরণ ও মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব সাংগ্রাইকে সামনে রেখে বাজারে কেনাকাটা করতেও যেতে পারছেন না তারা।
রুমা বাজারের ব্যবসায়ী রাজিব জানান, সাম্প্রতিক ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে বাজার এলাকায় অধিকাংশ দোকান বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়রাও দূর-দূরান্ত থেকে বাজারে আসছেন না। ফলে বাজারের অনেক কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রুমার পরিবহণ মালিক সমিতির লাইনম্যান জাকির বলেন, রোববার সকাল থেকে বান্দরবান-রুমা রুটে গণপরিবহণ চললেও অভ্যন্তরীণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না। রুমা থানার ওসি শাহজাহান বলেন, রুমা বাজার এলাকায় এখনও আংশিকভাবে দোকান বন্ধ রয়েছে। তবে সব সড়কে যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার কথা। থানচির বাসিন্দা মংব্রাচিং মারমা ও জসিম উদ্দিন বলেন, থানচি বাজারের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাজারের দোকানপাট খুললেও লোকজনের উপস্থিতি কম। সন্ধ্যা নামলেই অজানা শঙ্কায় মানুষজন সবকিছু গুটিয়ে নেন। পর্যটকদেরও কোনো উপস্থিতি নেই ৬ দিন ধরে। চিরচেনা সরগরম থানচি বাজার যেন জনশূন্য হয়ে পড়েছে। কোনো শব্দ শুনলেই মনে হচ্ছে গুলির শব্দ।
লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি ছয় দিনেও, ব্যাংক বন্ধ থাকায় ভোগান্তি : বান্দরবানে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫ গুলির হদিস ৬ দিনেও মেলেনি। গ্রেফতার করা যায়নি ঘটনায় জড়িত কাউকে। এদিকে থানচি, রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি করে ছয়টি শাখার কার্যক্রম গত বুধবার থেকে নিরাপত্তার কারণে বন্ধ রয়েছে। এ কারণে তিনটি উপজেলার বাসিন্দারা লেনদেন করতে না পারায় আর্থিক কষ্টে রয়েছেন। তিনটি উপজেলায় দু’টি ব্যাংকের এই ছয়টি শাখা ছাড়া আর অন্য কোনো ব্যাংকের শাখা নেই।
রুমায় সোনালী ব্যাংকের শাখায় গত মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটার দিকে হামলা করে অস্ত্রধারীরা ভল্টে থাকা ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা নিতে পারেনি। তবে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) নিজাম উদ্দিনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রুমা থেকে তাকে উদ্ধার করে র্যাব। ওই দিন পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫টি গুলি লুট করে অস্ত্রধারীরা। এলাকাবাসীর মুঠোফোনও নিয়ে গেছে তারা। পরদিন বুধবার থানচি থানার দুটি ব্যাংকের শাখা থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা লুট করে অস্ত্রধারীরা। এ ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় পৃথক ছয়টি মামলা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ সদস্যরা হামলার আগে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। এতে উপজেলা পরিষদ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। অস্ত্রধারীরা বান্দরবান-রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের অংশে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়। অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে দেরির কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, অস্ত্রগুলো উদ্ধারে অভিযান চলছে। এগুলো উদ্ধার না করে আমরা কি বসে থাকব? থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যাংকিং লেনদেন করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা খুব কষ্টে আছেন। একই অবস্থা রুমা উপজেলায়।
রুমা বাজারের ব্যবসায়ী হানিফ বলেন, লেনদেন করতে না পারায় তারা পঙ্গু হয়ে বসে আছেন।
কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যৌথ অভিযান চলবে : সন্ত্রাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত বান্দরবানের সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশের যৌথ অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। গতকাল রোববার বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড রিজিয়ন মাঠে অভিযানের খোঁজখবর নেওয়ার পর সাংবাদিকদের একথা বলেন তিনি।
সেনাপ্রধান বলেন, এর আগে এই কুকি-চিন সমতলে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে অস্ত্র চালানো, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ও পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর গত ২০২২-২৩ সালে বিভিন্ন সময়ে যৌথ অভিযানে এই সন্ত্রাসীদের মূল ক্যাম্পসহ তাদের অনেক আস্তানা দখলে নিয়েছিল যৌথ বাহিনী। পরে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে শান্তির আলোচনার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে তারা ধীরে ধীরে আবারও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে তাদের অবস্থান জাহির করেছে। সেসব বিষয় মাথায় রেখে এবারের যৌথ অভিযানে আমাদের যৌথ বাহিনীর যত সক্ষমতা আছে সব কিছু কাজে লাগিয়ে তাদের মূলোৎপাটন করার জন্য অভিযান পরিচালনা চলছে এবং চলবে।
তিনি জানান, সরকারের চলমান যৌথ অভিযানে এ পর্যন্ত দুটি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে সেগুলো সেদিনের লুট হওয়া অস্ত্র কি না খতিয়ে দেখে জানাতে পারব। অভিযানে সাধারণ নিরপরাধ জনসাধারণের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতার সাথে অপারেশন পরিচালনা করা হবে বলেও জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, সবশেষ কথা হলো সন্ত্রাসীদের এই স্বাধীন সার্বভৌমত্বের ভূখণ্ডে কোনো স্থান নেই। তাদের কোনোভাবে ঠাঁই দেয়া হবে না। তাদের পুরোদমে নির্মূল করে শান্তির পাহাড়ে পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনী অতীতেও কাজ করে আসছে ভবিষ্যতেও করবে। শুধু পাহাড়ে নয়, দেশে যেখানে অশান্তি হবে সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী কাজ করবে। এখানেও তাই করছি। তাই যেখানে শান্তি আছে সেখানে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই।
সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র ও সমর্থন পাচ্ছে কেএনএফ : এম সাখাওয়াত হোসেন: নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর রাজ্যের প্রভাবে বাংলাদেশে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আবির্ভাব ঘটেছে। এসব অঞ্চলে কুকি-চিনের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। চিন রাজ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এনডিএফ) মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বেশিরভাগ এনডিএফ সদস্য কুকি-চিন। এখান থেকে অনেক কুকি মিজোরাম গেছে। এই ইস্যুতেও সেখানে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। সাখাওয়াত হোসেনের পর্যবেক্ষণ, রুমা, থানচি ও আলীকদমের দূরত্ব কম নয়। অল্প সময়ের মধ্যে এই তিনটি উপজেলায় সাম্প্রতিক হামলা থেকে বোঝা যায় যে, কেএনএফ সদস্যরা নিজেদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে সুপরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে। তাদের শক্তি প্রদর্শন ইঙ্গিত করে যে, তারা এলাকাটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়।
মো: সাদাত উল্লাহ বান্দরবান থেকে জানান, কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বম গ্রফতার: বান্দরবানে বিশেষ অভিযান চালিয়ে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বমকে (৫৫) গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৫। গতকাল বিকালে সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের শ্যারনপাড়ার বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ বলেন, গ্রেফতার চেওসিম বম শ্যারনপাড়ার মৃত বোয়াল খুব বমের ছেলে। তার বাড়ি থেকে দুটি বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে। চেওসিম বমের বাড়ি ঘেরাওয়ের পর ভেতরে প্রবেশ করে র্যাব। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে ঘরের স্টিলের আলমারির ভেতর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আলমারিতে লুকিয়ে ছিলেন। কেএনএফ প্রধান নাথান বমের সঙ্গে চেওসিম বমের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বান্দরবানে কেএনএফের সশস্ত্র হামলা ও ব্যাংক লুটের বিষয়ে আমরা চেওসিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। একই সঙ্গে কেএনএফ প্রধান নাথান বম কোথায় আছে, তাও জানার চেষ্টা করব। কারা হামলা করেছে, কাদের সহযোগিতা ছিল তাও জিজ্ঞাসাবাদ করব। পাশাপাশি তার সহযোগীদের অবস্থান ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। গত ২ এপ্রিল রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও ব্যাংক কর্মকর্তাকে অপহরণের ঘটনার পর সাঁড়াশি অভিযান কার্যক্রম শুরু হয়।ইকিলাব
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com