রাঙ্গামাটি:- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার স্নাতক নাথান বম একসময় পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএসের ছাত্রসংগঠনে যুক্ত ছিলেন। তবে জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে পরে স্বতন্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কুকি-চিন জাতীয় উন্নয়ন সংস্থা। এরপর ২০১৭ সালে বম সম্প্রদায়ের দুই হাজার কর্মী নিয়ে গড়ে তোলেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। মূলত বম জনগণের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় সংগঠনটি। আর রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার ৯টি উপজেলা নিয়েই হবে এর ভৌগোলিক সীমানা।
এরপর নিজেদের সামরিক শক্তি জানান দিতে একের পর এক অপরাধ তৎপরতায় নামে সংগঠনটি। তবে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি থেকে সম্প্রতি সরে এসেছে কেএনএফ। নতুন দাবি ‘কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল বা কেটিসি গঠন। এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার সাতটি উপজেলায় পৃথক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য কেএনএফের এই দাবি ও অপতৎপরতাকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘জুম্মল্যান্ড’ বানানোর নীল নকশারই অংশ’ বলে মনে করছে পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা বিরোধী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ।
থামছে না অপতৎপরতা
২০২২ সালের জুনে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে জেএসএসের একটি ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যা করে সামরিক শক্তির কথা জানান দেয় কেএনএফ। ওই বছরের নভেম্বরে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান শুরু করলে ২৭০ জন কুকি ভারতের মিজোরামে পালিয়ে যায়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কেএনএফের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কেএনএফ ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। র্যাবের সঙ্গে দিনব্যাপী বন্দুকযুদ্ধের পর কেএনএফের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার হয় জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ১৭ জন কর্মী এবং কেএনএফের ৩ সদস্য। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম।
২০২৩ সালের মার্চে কেএনএফের হামলায় সেনাবাহিনীর একজন মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন ও দুই সেনা আহত হন। এপ্রিলে রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনী ও আরেক আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কেএনএফের আটজন নিহত হয়। ১৭ মে রুমার সুংসুংপাড়ায় সেনাবাহিনীর টহল টিমের ওপর গুলিবর্ষণ করে কেএনএফ। এতে সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা নিহত হন।
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে বৈঠক
পাহাড়ে কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা ও বাসিন্দাদের শান্তি বিঘ্নিত হতে থাকে। প্রশাসনের অভিযানে কিছুটা থেমে আবার শুরু হয় অপরাধ কর্মকাণ্ড। এর পরই পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘাত নিষ্পত্তির জন্য গঠন করা হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। উদ্যোগ নেওয়া হয় বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে কেএনএফের বৈঠকে বসার। সেই উদ্যোগের প্রাথমিক সাফল্যও আসে। ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের মধ্যে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল সংলাপ হয়। এরপর বান্দরবান জেলা পরিষদের সভাকক্ষে ৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফা ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ৫ নভেম্বর প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠকে বসে কেএনএফ-শান্তি কমিটি। সমঝোতা হয় সন্ত্রাস বন্ধে। সর্বশেষ গত ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফায় মুখোমুখি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কেএনএফের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিয়ে উভয়ের মধ্যে আলোচনা হয়। বৈঠকে কেএনএফ বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার, বিদেশে অবস্থানকারীদের ফিরিয়ে আনা এবং কেএনএফ সদস্যদের পুনর্বাসন করাসহ সাত দফা দাবি জানানো হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফার আলোচনার বিষয়গুলো নিয়ে এই এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আবারও শান্তি কমিটির সঙ্গে কেএনএফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যেই রুমা ও থানছিতে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ও অস্ত্র লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটল।
যে দাবিতে এগোচ্ছে কেএনএফ
সর্বশেষ বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লার নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে কেএনএফ। গত ১২ মার্চ একটি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কেএনএফের চেয়ারম্যান নাথান বমের উপদেষ্টা লালএংলিয়ান বম বলেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি আস্থা আছে বলেই পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি থেকে সরে এসেছে কেএনএফ। নতুন দাবি ‘কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল বা কেটিসি গঠন। এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার সাতটি উপজেলায় পৃথক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
আর এ দাবির তিন সপ্তাহ না যেতেই বান্দরবানের রুমা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি ও ব্যবস্থাপককে অপহরণ এবং পুলিশের অস্ত্র লুণ্ঠন করে। আবার এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গতকাল প্রকাশ্য দিবালোকে আরেক উপজেলা থানচিতেও সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির দুঃসাহস দেখাল কেএনএফ।
যা বলছে পাহাড়ের মানুষ
তবে এ ঘটনাকে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ বলে মনে করছেন পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতাবিরোধী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। সংগঠনটির মহাসচিব আলমগীর কবির বলেন, ‘কেএনএফের এ ধরনের দুঃসাহস রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ বলে মনে করি। তারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান বন্ধ রেখে শান্তি বৈঠক চলায় কেএনএফ অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। শান্তি বৈঠক চলা অবস্থায় কেএনএফের এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড বলছে শান্তি বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা নেই। এটা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘জুম্মল্যান্ড’ বানানোর নীল নকশারই অংশ। তাই পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তামিল টাইগারদের মতোই রাষ্ট্রীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত। আমরা ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুঠের তীব্র নিন্দা জানাই। একই সঙ্গে ব্যাংক ম্যানেজারের দ্রুত উদ্ধারের দাবি জানাই।’খবরের কাগজ
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com