ডেস্ক রির্পোট:- পার্বত্য চট্টগ্রামের গত তিন দিনে নতুন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়া বান্দরবানের পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনটি তিনটি ব্যাংকে ডাকাতি করেছে এবং এক কর্মকর্তাকে অপহরণ করেছে। এর ফলে পাহাড় আবার অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ঘটনায় আরেকটি নাম এসেছে—নাথান বম, যাঁর পুরো নাম নাথান লনচেও বম। বলা হচ্ছে, তিনি কেএনএফের প্রধান। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির মধ্যে ব্যাংক ডাকাতির মতো এত বড় ঘটনার নেতৃত্ব দেওয়া এই ব্যক্তি কে? কীভাবে তাঁর উত্থান হলো?
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ২ নম্বর রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেনপাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেওর ছেলে নাথান লনচেও বম। বাবা পেশায় জুমচাষি। মা মৃত রৌকিল বম গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছোট। স্থানীয় অধিবাসীদের তথ্য অনুযায়ী, নাথান বমের পরিবার ছিল অভাবী। নাথান বমদের পরিবার অনেক বড়। পরিবারের এত সদস্যের আহার জোগাতে নাথান বমকেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, জোন ও ব্রিগেডে সাহায্যের জন্যও যেতেন।
পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সন্তু গ্রুপের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে (পিসিপি) যোগ দেওয়ার কারণে নাথান বমের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন সন্তু লারমা। এরপর তাঁর জীবন ও পরিবারের জীবনধারা পাল্টে যায় ৷ পরিবারের অনেক সদস্য সরকারি চাকরি পান। নিজের স্ত্রী লাল সমকিম বম রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে যোগ দেন। তাঁদের দুটি শিশুসন্তান আছে।
নাথান বমের উত্থান যেভাবে
পাহাড়িদের একটি পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আবেদন করতে পারলেও ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। ঘটনাচক্রে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীণ উপাচার্য ও বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এমাজউদ্দীন আহমদ একবার বান্দরবান সফর করে খিয়াং, লুসাই, ম্রো, বম জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দেন।
আর তাই পরীক্ষায় পাস না করতে পারলেও এমাজউদ্দীনকে ওয়াদা স্মরণ করিয়ে পিসিপি নেতারা নাথান বমকে চারুকলা অনুষদে ভর্তি করার সুপারিশ করেন। তাঁদের চাপে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্রজীবনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন নাথান।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর সহশিল্পী নিম্মী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তখন হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
নাথানদের নির্মিত লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বাড়ে। তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।
তখন থেকেই তিনি কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সংগঠনের পক্ষে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন নাথান। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁর আর ভোট করা হয়নি।
নাথানের গড়ে তোলা কেএনডিও পরে নাম বদলে হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি)। আরও পরে ২০১৯ সালের দিকে হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এর সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেওয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
পরিবারের এত সদস্যের আহার জোগাতে নাথান বমকেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, জোন ও ব্রিগেডে সাহায্যের জন্যও যেতেন। ছবি: সংগৃহীতপরিবারের এত সদস্যের আহার জোগাতে নাথান বমকেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, জোন ও ব্রিগেডে সাহায্যের জন্যও যেতেন। ছবি: সংগৃহীত
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বম পার্টি নামেও পরিচিত কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম ভারতের মিজোরাম রাজ্যে অবস্থান করছেন। মূলত বমরাই এর সদস্য। এটি রাঙামাটি ও বান্দরবানের ৯ উপজেলায় বমসহ ৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ‘কুকি-চিন রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে। সংগঠনের শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ২০১৯ সালে ফিরে আসে।
বান্দরবানের রুমা সীমান্ত ও মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে এর সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কেএনএর ৬০০-এর বেশি সদস্য আছে। তাঁরা চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে পুরো জেলায় আতঙ্ক তৈরি করেন। রুমা ও থানচি উপজেলায় তাঁদের উৎপাত বেশি।
জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসারের সঙ্গে নাথানে সম্পর্ক
গত বছরের ২৪ জুলাই পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার যোগাযোগের নতুন তথ্য সামনে আনে র্যাব। জামাতুল আনসারের কথিত আমির মো. আনিসুর রহমান মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর নাথান বমের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগের কথা জানায় র্যাব।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মইন সেদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এই আনিসুরের মাধ্যমে ঢাকার বাসাবো এলাকার একটি ভাড়া বাসায় আট মাস ছিলেন কেএনএফ নেতা নাথান বম। আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ কুকি-চিন প্রধানকে বাসাটি ভাড়া করে দেন। বাসাটি ২০ হাজার টাকায় ভাড়া করা হয়েছিল। আর নাথান বমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল আমিরের।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) তথ্য অনুযায়ী, নাথান বম যখন চারুকলার ছাত্র, জামাতুল আনসারের নেতা শামিন মাহফুজ তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। সে সময় তাঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
জামাতুল আনসারের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে যখন দুর্গম জায়গা খোঁজা হচ্ছিল, তখন শামিন মাহফুজ জানতে পারেন, তাঁর বন্ধুই বম পার্টির প্রধান। এরপর তাঁদের মধ্যে সাংগঠনিক পর্যায়ে যোগাযোগ ও চুক্তি হয়।
২০২২ সালের অগাস্টে কুমিল্লা ও ঢাকার সাত কলেজছাত্র বাসা থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। অক্টোবরে কয়েকজনকে উদ্ধারের পর নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের নাম প্রকাশ্যে আসে। র্যাবের দাবি, এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ঘর ছেড়েছিলেন তাঁরা। অন্যদিকে পাহাড়িদের কাছে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত কেএনএফ সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বেশ কয়েক মাস ধরেই ছিল আলেচনায়। পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য তারা ‘কুকি-চিন রাজ্য’নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
জামাতুল আনসারের ডজনখানেক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব সংগঠনটির ‘বম পার্টি’র সঙ্গে সংযোগের কথা জানায়। পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে সে সময় র্যাবের ভাষ্যে উঠে আসে। এ দুই উগ্র সংগঠনের সম্পর্কের বিষয়টি জানার পরই অক্টোবরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বিত অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই অভিযানের সময়ই কুকি-চিন বা ‘বম পার্টি’র নেতা নাথান বম ঢাকায় ছিলেন বলে র্যাব জানায়।
হিলভয়েসের তথ্য অনুযায়ী, কেএনএফে সদস্যদের সঙ্গে ‘জামায়াতে আরাকান’ নামে একটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সশস্ত্র গোষ্ঠীরও যোগসূত্র রয়েছে। এ দুই সংগঠনকে ঢাকার এক বম তরুণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলো অর্থ পাঠায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
র্যাব বলছে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে নাথান বমসহ কেএনএফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আসলাম নামের এক ব্যক্তির সাথে গহীন পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে যান আনিসুর। সেখানে আসলামের তত্ত্বাবধানে তিনি প্রশিক্ষণ নেন।
প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় এসে নিজের সম্পত্তি ৫০ লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি করে দেন। এরপর নাইক্ষংছড়িতে তিন বিঘা জায়গা কিনে পরিবারসহ থাকতে শুরু করেন। তিন বিঘা জমির দাম দিয়ে বাকি টাকা তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠনকে দেন।
কেএনএফ প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফের ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়।
সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি জামাতুল আনসার কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করত বলে র্যাবের ভাষ্য।
সম্পাদক : এসএম শামসুল আলম।
ফোন:- ০১৫৫০৬০৯৩০৬, ০১৮২৮৯৫২৬২৬ ইমেইল:- smshamsul.cht@gmail.com
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com